ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে ‘বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নিজ স্বার্থে’

 In দেশের বাইরে, রাজনীতি

 

ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে ‘বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নিজ স্বার্থে’

কাশ্মিরের সেনাঘাঁটিতে ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলায় নতুন করে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত-পাকিস্তানের। চিরবৈরি দেশ দুটির দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে নিজ দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ বলে মত প্রকাশ করেছেন সাবেক কূটনীতিকরা।

উরি সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলার ওই ঘটনায় বাংলাদেশ দুঃখ প্রকাশ করে এ কঠিন সময়ে দেশটির পাশে থাকার কথা জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে পাঠানো এক চিঠিতে এ আশ্বাস দেন।এ হামলায় ১৭ সেনা নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়। পাল্টা আক্রমণে ৪ জঙ্গি মারা যায়।

একইভাবে ১ জুলাই গুলশান হামলার সময়ও বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা বলেছিল ভারত।

বাংলাদেশ এ অঞ্চলে শান্তির পক্ষে। ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিবেচনায় নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনাতে রেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এমনটিই বলছেন সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান  বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও উগ্রবাদী সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অংশ হিসেবেই ভারতের পাশে থাকার কথা বলেছেন। তিনি এ অঞ্চলের সীমানাজুড়ে চলমান সব হুমকি নির্মূলে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এরই অংশ হিসেবে এটি তার অবস্থান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারতের মতো এমন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর পাশে থাকার বিষয়ে এ সমর্থন জানিয়ে ঠিক কাজটিই করেছে। পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। তবে বাংলাদেশকে নিজকে সংরক্ষিত করে, নিজ অধিকারকে সংরক্ষিত করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে শান্তি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নই আমাদের টার্গেট।

ওয়ালিউর রহমান বলেন, জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী একটা দেশ আর একটা দেশকে কোনোভাবেই আক্রমণ করতে পারবে না। পাকিস্তান বরাবরই এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে লস্করে তৈয়াবা বা জাইসে মোহাম্মদের নাম নিয়ে। লস্করে তৈয়াবা ও জাইসে মোহাম্মদ হল পাকিস্তানের আইএসআই-এর দুই হাত। ওদের নামে এগুলো করছে, তবে মূলত এগুলো পাকিস্তান আর্মি করছে। পাকিস্তান আর্মি ওদের গোলবারুদ দিচ্ছে, প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্যায় করে এলওসি (লাইন অব কন্ট্রোল) অতিক্রম করছে। কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তান হেরে এলওসি মেনে নিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কোনো প্রকার অধিকার নেই ভারতের দিককার কাশ্মিরে এ ধরনের আক্রমণ করার।

তিনি বলেন, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভেতরে গিয়ে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সমর্থন দিতে পারে না। বরং বাংলাদেশ ভারতের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ ভারতের একটি অংশে পাকিস্তান হামলা করেছে এটাকে কখনই গ্রহণ করা যেতে পারে না। এটা জাতিসংঘের চার্টার, ১৯৪৮ সালে হিউম্যান রাইট কনভেনশন ও সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইট কনভেনশনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান।

তবে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার বিপক্ষে এ প্রাজ্ঞ কূটনীতিক। পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যক্রম কিছুটা সংকুচিত করে আনার পক্ষে মত দেন তিনি।

বলেন, রাষ্ট্রদূত না রেখে একজন কাউন্সিলর রাখা যেতে পারে। তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

এদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত আশাফাকুর রহমান বলেন, এটি সত্য পাকিস্তানের সঙ্গে এ অঞ্চলে কারোও সম্পর্ক ভালো নেই। সংবাদে বেরিয়েছে, পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় আসন্ন সার্ক সম্মেলনে ভারত, বাংলাদেশ এমনকি শ্রীলঙ্কাও যাচ্ছে না। পাকিস্তান দেশটি আসলে নিজেকে একঘরে করে ফেলেছে তার আচরণ ও কার্যকলাপের মাধ্যমে।

তিনি বলেন, পাকিস্তানকে কাশ্মির নিয়ে একটা রাজনৈতিক সমাধানে আসতে হবে। পাকিস্তান সন্ত্রাসের এ খেলা আর কদিন খেলবে। লস্করে তৈয়াবা  ও জাইসে মোহাম্মদ দিয়ে ভারতের মাটিকে আক্রমণ করছে। ভারত ও পাকিস্তানকে কাশ্মিরের জনগণের কথা ভাবতে হবে। কাশ্মিরের মানুষের কথা ভেবেই এবং তাদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই কাশ্মিরকে স্বাধীকার দেওয়া উচিৎ। কাশ্মির সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই পরিষ্কার। কাশ্মিরের জনগণ নির্ধারণ করবে তারা কীভাবে, কোথায় থাকবে?

আশফাকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। ভারত বা পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাবিত না হয়ে আমরা এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। কিন্তু এ অঞ্চলে পাকিস্তান করছে সন্ত্রাস। কাশ্মিরে পাকিস্তান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত রয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান ভারতের মাটিতে তাদের সৈন্যদের হত্যা করেছে। এরপরে কি পাকিস্তান পার পাবে? অবশ্যই নয়। তাদেরকে এ জন্য ভুগতে হবে। এটা তো উস্কানি। এর দায়ভার পাকিস্তানকে নিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ অবশ্য কথা বলতে পারেন না। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট। তাকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর প্রভাব সর্বত্র। সেখানে নামমাত্র গণতন্ত্র রয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান যে সকল মন্তব্য করেছে তা কোনো গণতান্ত্রিক সরকার করতে পারে না। পকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব বিবৃতি দিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বাধ্য করে। এসকল কোনো গোপন বিষয় নয়, আমরা সকলেই এটি জানি। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী? যদি মার্ক করা হয় এখন ১০ এর মধ্যে মাত্র ২ নম্বর পাবে।

তবে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে শেষ করে দেওয়ার পক্ষপাতি নন এ অভিজ্ঞ কূটনীতিকও।

তিনি বলেন, ইরাক-ইরান ৯ বছরের যুদ্ধের সময় লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার হয়েছে, গণহত্যা হয়েছে। তারপরও তারা নিজেদের মধ্যে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। একটা পর্যায়ে যোগাযোগ থাকতেই হয়। বাংলাদেশ সবসময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাস করে কেউ একটি দেশকে ভয় দেখাতে পারবে না। কিন্তু কোনো দেশ যখন কোনো অঞ্চলের মানুষের ওপর অন্যায় করবে তখন বিনয়ের সাথে আমরা তাদের বলব। সেখানে জনগণের ইচ্ছার মূল্য দিতে হবে। আমরা ঠিক পথে চলেছি। তবে বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়। বাংলাদেশ ওআইসি ও সার্কের সদস্য।

তার মতে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাশ্মিরের জনগণের স্বাধিকারের কথাও আমাদের বলা উচিৎ। এটা তো বলি না, আমরা এটাতে জড়াতে চাই না বলে। বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন স্বরূপ। আমরাও মানুষের ইচ্ছাকে দাম দেব। এটি কোনো সামরিক সমস্যা নয়, এটি রাজনৈতিক সমস্যা।

Recent Posts

Leave a Comment