মাশরাফিদের ম্যাচ থাকলে তাদের রুটি-রুজি বন্ধ

 In খেলাধুলা, বিশেষ প্রতিবেদন

 

শিরোনাম দেখে চমকে উঠতে পারেন! যে মাশরাফি-মুশফিকরা মাঠে থাকলে গোটা বাংলাদেশ জেগে ওঠে তারাই কিনা কারো রুটি-রুজি কেড়ে নিচ্ছেন? আন্তর্জাতিক সূচিতে মিরপুরের ম্যাচ মানেই কিছু মানুষের মুখের হাসি কর্পূরের মতো উধাও! অথচ তারা ভিনদেশি কেউ নন। এমন প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত হওয়ার অনেক কারণ থাকলেও এটাই সত্য। হোম অব ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক ম্যাচ মানেই তাদের মাথায় হাত।

তাদের দেশদ্রোহী অপবাদ দেয়ার আগে কিছুটা সময় নিন। চলুন শুনে আসি তাদের কথা। দেখে নেই কেনইবা এভাবে ভাবছেন তারা। শেরে-ই-বাংলার ৫ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে মিরাজ ফার্নিচার। কাঠ-প্লাস্টিকের পসরা সাজানো আছে। সেখানেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী পরিবর্তন ডটকমকে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ এই মাঠে খেলতে নামলে সবাই উচ্ছ্বসিত হলেও আমরা ভাই খুশি হতে পারি না। তারা খেললে আমাদের ব্যবসা বন্ধ। নিরাপত্তার কথা বলে আমাদের দোকান খুলতে দেয় না। আর দোকান না খুললে বুঝেনই তো পেটে ভাত পড়ে না।’

মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্বর থেকে হাঁটা দূরত্বের এই মাঠটি অবশ্য ফুটবলের জন্য তৈরি হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) কাছ থেকে ভাড়া নেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। যেটি পরে পুরোপুরি ক্রিকেটেরই মাঠ হয়ে উঠেছে। ফুটবল থাকার সময় অবশ্য এমন ঝামেলায় পড়তে হয়নি এখানকার দোকান মালিকদের। কিন্তু বিসিবি যখন এখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরাল তখনই একের পর এক জটিলতার মুখে পড়তে থাকল স্টেডিয়াম চত্বরের দোকানগুলোর মালিকরা।

শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সেই শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে এখানে ব্যবসা করতে এসেছিলাম। এনএসসির মাধ্যমে আমরা দোকান নিয়েছি। সেটা অনেক অনেক আগের কথা। এই স্টেডিয়াম সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব করে যান। তারপর ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে দোকানের বরাদ্দ দেয়া শুরু হয়। সর্বশেষ ২০০৩ সালে ৯০ বছরের জন্য দোকানগুলো লিজে পেয়ে যাই আমরা। তারপর শান্তি মতো ব্যবসা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখুন, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আমাদের বছরের প্রায় সময়টাতেই দোকান খুলতে দিচ্ছে না।’

শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম মার্কেটে আগে দোকান ছিল ৮৬টা। কর্মচারীদের বেতন দিতে না পারায় বেশ কয়েকজন মালিক বড় দোকানগুলো দু-ভাগ করে ভাড়া দিয়েছেন। তাতে এখন দোকান এখন প্রায় ১০০টির মতো।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে রোববার টাইগারদের প্রথম ওয়ানডের আগে সেই কষ্টের কথা আবারো শোনালেন মিজানুর রহমান। দোকান-মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন ডটকমকে বলছিলেন, ‘আমরা ভিআইপি জোন থেকে অনেক আগেই সরে এসেছি। সাধারণ গ্যালারির নিচে আমাদের দোকান। তারপরও শুধুমাত্র নিরাপত্তার অজুহাতে আমাদের মার্কেট

 

থেকে বের করে দেয়া হয়। ওরা এমনভাবে আটকে দিয়েছে যে আমাদের হাত-পা বাঁধা। শুধুমাত্র নিরাপত্তাকে ইস্যুকে করে তারা এটা করেছে। এটা তো দেশের স্বার্থের একটা ব্যাপার। তাই আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।’

দোকান বন্ধ থাকলেও কর্মচারীদের বেতন তো দিতেই হচ্ছে। গুডলাক ফার্নিচারের কর্ণধার মিজান বলছিলেন, ‘আমার পুঁজি এখানে আটকে রয়েছে, আর আমি রাস্তায়। আমার কর্মচারীদের বেতন, যাবতীয় খরচ সম্পূর্ণ কিন্তু বাসায় বসে বহন করতে হচ্ছে। বারবার আমরা ক্ষতিপূরণ চেয়েও পাইনি। একবার এনএসসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আমাদেরকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা দেবে। তারা বিসিবির কাছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ হাজার টাকা দেয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু বিসিবি সেটা গ্রহণ করেনি।’

স্টেডিয়াম মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক মনে করেন এভাবে চলতে থাকলে এখানে ব্যবসা করা সম্ভব হবে না। তার ভাষায়, ‘আমার কর্মজীবন থেকেই আমি এখানে ফার্নিচার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আগে শুধুমাত্র রোববার মার্কেট বন্ধ থাকতো। আমরা এই পর্যায়ে কর্মচারীর বেতন দিতে যেয়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি। এখন আফগানিস্তানের সঙ্গে সিরিজ। এরপর আসছে ইংল্যান্ড। সেই সিরিজ শেষ হলেই হবে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। আমাদের সঙ্গে বিসিবির কথা হয়েছিল বিপিএলে সব দোকান খোলা থাকবে। তবে এখন আবার সুর পাল্টেছে ক্রিকেট বোর্ড। বিদেশি ক্রিকেটার থাকবে, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ থাকবে মার্কেট। আমরা কোথায় যাই, বলুন?’

 

মার্কেটের মালিকরা যে ক্ষতিপূরণ একেবারেই পাননি তা কিন্তু নয়। এনএসসি সূত্রে জানা গেছে, দোকান বন্ধের কারণে ১৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাস হয়েছে। যার প্রথম কিস্তিটাও দেয়া হয়েছে। এই তথ্যের সঙ্গে অবশ্য দ্বিমত করলেন না মার্কেটের মালিক সমিতির কর্তারা।

তবে তাদের দাবি সেটা দিয়ে ‘দোকানে চায়ের পানিও গরম হয় না।’ সরকারি চুক্তি অনুযায়ী, দোকানে প্রতি স্কয়ার ফিট আগে ছিল ৪ টাকা। সে সময় দোকান ভাড়া ছিল ৩ হাজার ৮০০ টাকা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে সাড়ে পাঁচ টাকা প্রতি স্কয়ার ফিট। এখন দোকান ভাড়াও বেড়েছে। মার্কেটের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ক্রিকেট ম্যাচের জন্য দোকান বন্ধ ছিল ছয় মাস। এই সময়ে একটি বড় দোকান ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক মাসের হিসেবে পেয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৮০০ টাকা।

পুরো ব্যাপারটি নিয়ে শুধু এনএসসিই নয়, দোকান মালিক সমিতি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীদেরও দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলছিলেন, ‘দেখুন, শীতকালেই আমাদের ব্যবসা। আর এ সময়টাতে রমরমা থাকে ক্রিকেট। আমরা কী করবো বলুন। এনএসসি থেকে শুরু করে গিয়েছি ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে। কিন্তু সবারই একই কথা, নিরাপত্তা। আর এজন্য সবাই চুপ। আমার প্রশ্ন বিসিবিকে তো আমরা একটা সাইড করে দিয়েছি। আমাদের একটা সাইড হয়েছে। সাধারণ গ্যালারির নিচে আমরা দোকানদারি করছি। যদি কোনো বহির্বিশ্বের কোনো লোক মাঠ পরিদর্শন করতে আসে। তারা কিন্তু এদিকে আসে না। তবে কেন আমাদের দোকান বন্ধ থাকবে?’

 

সবাই চুপ থাকলেও হাল ছাড়েননি দোকান মালিকরা। তারা এটা নিয়ে হাইকোর্টে ২০১৪ সালে মামলাও করেছিলেন। পরে মীমাংসা হলে কিছুদিন আগে কেস তুলে নেয়া হয়। সে অনুযায়ী বিসিবির ওই পাশে যেসব দোকান ছিল সেগুলো এই দিকে সরিয়ে আনা হয়।

পুরো ব্যাপারটি নিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিসিবির কর্তাদের সঙ্গে  যোগাযোগ করা হয়। নাম প্রকাশ না করে একজন জানালেন, ‘নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে গোটা দেশ কতটা উদ্বিগ্ন তা ভাল করেই জানেন। ইংল্যান্ডকে বাংলাদেশ সফরে রাজি করাতে কতটা ঘাম ঝরাতে হয়েছে সেটাও জানেন। সত্যি কথা বলতে কী, নিরাপত্তা ইস্যুতে একবিন্দুও ছাড় দেয়া হবে না। মার্কেট খোলা থাকলে আন্তর্জাতিক ম্যাচে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় তার দায় কে নেবে?’

বাস্তবতা দোকান মালিকরাও বোঝেন। সবার আগে দেশের স্বার্থ। তাইতো আন্তর্জাতিক ম্যাচে দোকান বন্ধ নিয়ে আপাতত তারা তেমন সরব হচ্ছেন না। তবে বিপিএল চলাকালে যে মার্কেট বন্ধ না রাখা হয় সেই দাবিও উঠছে। একইসঙ্গে দোকান বন্ধের জন্য যে ক্ষতিপূরণ বরাদ্দ হয়েছে সেটা বাড়ানোরও জোর দাবি করছেন মালিকরা। আর সেটা হলেই গোটা দেশের মতো মিরপুরে মাশরাফি-মুশফিকদের ব্যাটে-বলে ঝড় তাদেরও খুশির বন্যায় ভাসিয়ে দেবে।

Recent Posts

Leave a Comment