গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়ে যায়। স্থানান্তরিত এসব টাকা ফিলিপাইনে পাঠানো হয়। দেশের অভ্যন্তরের কোনো একটি চক্রের সহায়তায় হ্যাকার গ্রুপ রিজার্ভের অর্থ পাচার করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্ট উপ-পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মতিঝিল থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) এর ৪ সহ তথ্য ও প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৪ ধারায় ও ৩৭৯ ধায়ায় বাদী হয়ে মামলাটি করেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের আটতলার বিশেষ ঘর থেকে সুইফটের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়। ব্যাংকের আট কর্মকর্তার কাছে সুইফট আইডি থাকে। তারাই শুধু সুইফট সার্ভার ব্যবহার করতে পারেন। লোকাল সার্ভার, সুইফটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ব্যাংক থেকেই হ্যাকারদের জানানো হয়েছিল। সুইফট স্মার্টকার্ড কোনোভাবেই ভল্টের বাইরে রাখা যায় না। পেমেন্টের পরেও সেটা বাইরে ছিল। সুইফট সার্ভার, লোকাল ইন্টারনেটের সঙ্গে যারা যুক্ত করেছে তারাই আসামি। এক বছর আগে সব বেসরকারি ব্যাংক সুইফট নেটওয়ার্কের সঙ্গে রিয়েল টাইম গ্রোস সিস্টেম বা আরটিজিএস ব্যবহারের সুযোগ পায়। মাত্র তিনটি ব্যাংক সেটা কাজে লাগায় ৪ ফেব্রুয়ারি। সে দিনই চুরির ঘটনা ঘটে।
সূত্র আরো জানায়, বিদেশি অপরাধী তালিকায় রয়েছে জাপানের সাসাকিম তাকাশি, জয়দেবা। আরসিবিসির জুপিটার শাখার মায়া সান্টোস দেগুইতো ফিলিপিনের ক্যাসিনো ইস্টার্ন হওয়াই লেইসার কোম্পানির মালিক কিম অং, ফিলরিমের প্রেসিডেন্ট ¯œুইড বাতিস্তা, ফিলিপিন্সের বণিক উইলিয়াম গো সোসালিকা ফাউন্ডেশনের ছয় পরিচালক গামাজ সালিতা পেরেরা, সানজেবা টিসা বান্দারা, শিরানি ধার্মিকা ফানান্দো, ডন প্রসাদ রোহিতা, নিশান্থা নালাকা, ওয়ালাকুরুয়ারাচ্চি। যথার্থ প্রমাণ মেলাতেই চার্জশিটে তাদের নাম থাকতে পারে। তদন্তের শেষ পর্যায়ে অপরাধীর তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে বলেও সূত্র জানায়। কেউ যাতে পার না পায়, সতর্ক বাংলাদেশের নিরাপত্তা দপ্তর। তাদের তদন্তের সাফল্যেই চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পেতে কৌশল পরিবর্তন করা হয়েছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে ড. ফরাস উদ্দীন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, রিজার্ভের অর্থ চুরির সঙ্গে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনকে (সুইফট) দায়ী করা থেকেও সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে। এরই অংশ হিসেবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও সুইফটের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার যে প্রস্তুতি নিয়েছিল, তা থেকে সরে এসেছে। রিজার্ভের চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠানই নয়, সব পক্ষের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক (ফেড), সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট), ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক (ফিনসেন), যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, দ্য ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সঙ্গে বৈঠক করেন।
এদিকে রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির পর বিশাল আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক রক্ষায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বিশ্বের বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর একটি আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। মূলত চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সরিয়ে নেওয়ার পর সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উঠে আসে।
সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর বিশ্বের প্রধান প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা সুইজারল্যান্ডের বাসেলে অবস্থিত ‘দ্য কমিটি অব সেন্ট্রাল ব্যাংকস’ একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। এই কমিটি ‘ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস’ (বিআইএস)-এর অংশ। গঠিত টাস্কফোর্স ব্যাংক প্রতারণা থেকে রক্ষার জন্য সদস্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করছে। মূলত আন্তঃব্যাংক অর্থ লেনদেনে একটি বৈশ্বিক মান গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি নতুন নির্দেশনা মানা হবে। যেখানে অর্থ লেনদেনে ব্যাংকগুলোর দায়বদ্ধতা এবং সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক ব্যাংক লেনদেনের বিষয়েও বিস্তারিত নির্দেশনা থাকবে। হ্যাকিং প্রতিরোধ করতে যদি কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থও হয়, এ ক্ষেত্রে অন্য ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়েও নির্দেশনা থাকবে।
এই টাস্কফোর্স গঠনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় রয়েছে বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন-এসডব্লিউআইএফটি), নিউইয়র্ক ফেডও এই টাস্কফোর্স গঠনে অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া ২৫টি শীর্ষস্থানীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ টাস্কফোর্সের সঙ্গে আছে। তবে এ বিষয়ে বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সুইফট ও নিউইয়র্ক ফেডের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।