সেলফি বর্তমানে এক সর্বনাশা অসুখের নাম। নিজেকে দেখবার গভীর অসুখে সে আজ আচ্ছন্ন। মিথ্যে ভাল লাগবার খেলায় বিষাদগ্রস্ত। এতদিন আমরা জানতাম, শুধু নিজের দিকে তাকাতে নেই। সবার দিকে তাকাও। এখন জানছি, শুধু নিজের দিকেই তাকাও। নিজেকেই দেখো।
দুনিয়ার যাবতীয় শখ–আহ্লাদ, সব ভাল মন্দ’র সামনে দাঁড়িয়ে থাকব শুধু আমি, আমি এবং আমি। কেউ বলছে, অসুখ, কেউ বলছে বদভ্যাস, কেউ বলছে উচ্ছৃঙ্খল, কেউ বলছে সমাজের দোষ। আমি বলছি, চক্রান্ত। পরিকল্পনা করে এই সেলফির নেশা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম দিয়ে এই চক্রান্তের সূচনা। ছড়িয়ে পড়েছে সব বয়েসে। তিন বছরের শিশু থেকে তিরাশি বছরের বৃদ্ধবৃদ্ধাও এখন আক্রান্ত। চক্রান্তের একটাই লক্ষ্য, তুমি থাকো আত্মমগ্ন, আত্মরতিতে সুখী।
নিজেকে নিয়ে যত মেতে থাকবে, তত অন্যদিকে নজর থাকবে না তোমার। তোমার ছবি কে তুলল তাতে কী এসে যায়? তুমি ছবি তোলবার মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ হলে কি না তাতে কী এসে যায়? ছবিতে তোমায় কেমন লাগবে কী এসে যায়? নিজের ছবি তুলতে গিয়ে ছবি তোলবার মতো অন্য কেউ হারিয়ে গেল কি না তাতেই বা কী এসে যায়? তুমি নিজেই তোমার ছবি তোলো। তারপর ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে নিজেকে দেখো। দেখতেই থাকো। দেখতেই থাকো। কিন্তু খবরদার। অন্যের দিকে নজর নয়। তার দুঃখ, তার অপমান, তার বঞ্চনা, তার কষ্ট, তার খেতে না পাওয়া শুকনো মুখ নিয়ে তোমার কী হে? তুমি দেখবেও না, ভাববেও না। এটা চক্রান্ত নয়?
যারা নিজের ছবি নিয়ে পাগলামি করে তাদের মধ্যে বহু গাধাও রয়েছে। সেলফি গাধা। এই সেলফি গাধারা চরম বিপদে পড়ছে। কেউ চলন্ত ট্রেনের সামনে ছবি তুলতে যাচ্ছে। যাতে সেই ছবি ফেসবুকে দেখে সবাই তাকে সাহসী ভাবে। কেউ বাঘের খাঁচায় ঢুকে ছবি তুলতে যাচ্ছে বাঘমামার সঙ্গে। লোকে যেন ছবি দেখে সিনেমার হিরো ভাবে। কেউ পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চায়। আহা দেশ, আমি সিনেমার হিরোইন হয়েছি। কেউ উন্মত্ত সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে অকাতরে বিলোতে চায়। এর ফল কী? এর ফল একটাই। মর্মান্তিক মৃত্যু।
সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুকে ডেকে আনা দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার চেয়ে লজ্জা আর গ্লানির কিছু হতে পারে না। আমরাই কি তবে সব থেকে বোকার দেশ হয়ে যাচ্ছি? আসলে সেলফি সমস্যাটি অনেক গভীরে। বোধ, বুদ্ধি সচেতনতায়। যে সময় মানুষকে শুধু স্বার্থপর হতে শেখাচ্ছে, সেখানে এই ধরনের ভয়ঙ্কর খেলা চলতেই থাকবে। পিছনে কলকাঠি নাড়বে, যারা নামীদামি মোবাইল বানায় ও বিক্রি করে।
কিছু অপরিণত, কিছু স্বার্থপর, কিছু হীনমন্যতায় ভোগা মানুষ এবং কিছু গাধাকে সেলফির নেশায় মাতিয়ে রাখবে যতদিন পারবে। তারপর নতুন খেলা আসবে। নতুন চক্রান্ত। হয় পাহাড় থেকে খাদে পড়বে, হেলিকপ্টারসহ বিধ্বস্ত হয়ে মরবে! এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের মা-বাবারা বেঁচে গেছেন।সেলফির নেশা তাদের গিলতে পারেনি।
যে নেশাটা এখনকার জেনারেশনকে তাড়িয়ে ফিরছে, আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা বেশ মারাত্মক এবং মারণ। এই নেশার দুটো উপকরণ। একটা টাচ ফোন, অন্যটা সেই টাচ ফোনের সাহায্যে আনা নানান কেরামতি। বছরকয়েক হল প্রযুক্তি আমাদের সঙ্গে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম এবং আরও কত আগডুম-বাগডুমের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। এতে কাজের কাজ কী হচ্ছে, জানি না, তবে মানুষ বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। ফোনের স্কিন ছাড়া অন্য কোনো দিকে কারও তেমন মন নেই। ছেলে-ছোকরা থেকে বুড়ো-হাবড়াদেরও দেখছি এই নেশায় বুঁদ হতে।
আজকাল মোবাইল ফোনে সেই অর্থে কোনও চার্ম নেই। এমন লোক খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর যে মোবাইল ব্যবহার করে না। খবরের কাগজগুলো আজকাল প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বছরে বছরে মডেল বদলাচ্ছে। যত দামিই হোক না কেন এক একটা ফোনের আয়ু বড়জোর এক-দেড় বছর। কার মডেল কত নতুন, তার প্রতিযোগিতা চলছে আজ বহুদিন।
বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর বহু দেশেই মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রির গ্রোথ সবচেয়ে বেশি। ফোন বদলের এই নেশা বর্তমানে ছোঁয়াচে রোগের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছর বছর ফোন বদলাও যার যেমন ক্ষমতা। এ বাবদ পকেট যে কীভাবে খোয়া যাচ্ছে তা টের পাওয়াও দুষ্কর।
প্রাণ হরণের ক্ষেত্রেও এই মোবাইলের জুড়ি নেই। দু’কানে বোতাম ঢুকিয়ে গান শুনতে শুনতে অথবা কথা বলতে বলতে লোক গাড়ি চাপা পড়ে মরছে। তবে সেলফির নেশা নবীন প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি উম্মাতাল করে তুলেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক তরুণের মনে হল আজ সে অফিস যাবে না। মুখটা একটু করুণ-করুণ করে আলুথালু চুল। সে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে লিখল, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, টেকিং রেস্ট। মুহূর্তের মধ্যে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে কী? কেন? কাল রাতে কী খেয়েছিলি? জ্বর আছে? গায়ে ব্যথা? ব্লাড টেস্ট করা। ডেঙ্গু হল না তো? ডাক্তার দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারটা উদ্বেগ ও ফ্রি অ্যাডভাইস। ডেঙ্গু হলে কী কী করতে হবে, সেই ফিরিস্তিও চলে এল।
একজনের দাদী মারা গেছেন। পরিণত বয়সেই। তাঁর মরদেহ কাঁধে নাতিরা পালা করে করে সামনে এসে সেলফি তুলে পোস্ট করছে, গ্র্যান্ডমা ফাইনালি গন। স্কোরড নাইনটি ওয়ান। ভাবখানা এমন, দাদী গেছেন, কী আনন্দ, কী আনন্দ! প্রতিদিন প্রতিটা মুহূর্তে যা ঘটছে, ঘটা করে তা সবাইকে না জানালে যেন এই বেঁচে থাকাটাই বৃথা। এসব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, আজকের দিনে যদি সহমরণ চালু থাকত, তাহলে স্বামীর সঙ্গে চিতায় উঠতে উঠতে স্ত্রীও সেলফি তুলে ফেসবুকে দিয়ে বলতেন, গুড বাই..!
যারা নিজের রূপ ও নিজেকে নিয়ে মগ্ন তারা অবশ্যই মানসিক রোগী। নিজেই নিজের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। প্রতিনিয়ত তারা নিজেকে নতুনভাবে বিকশিত হতে দেখতে ভালোবাসে। ইংরেজিতে একে বলে, ‘নার্সিসিজম’। এটা যতটা সুখ তার চেয়ে বেশি অসুখ। নেশাগ্রস্ত এই অসুস্থরা দিন দিন রক্তবীজের ঝাড়ের মতো বেড়ে চলেছে। মারাও পড়ছে। কীভাবে এই সেলফি তোলার রোগের মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা দরকার।
পুনশ্চ: কিছুদিন আগে এক বন্ধুর ফেসবুক ওয়ালে সেলফির একটি সংজ্ঞা দেখেছিলাম, ‘ঊর্ধ্ব গগনে তুলিয়া ফোন, নিম্নে ক্যালানো এক বদন’। সেটা পড়ে খুব মজা পেয়েছিলাম! যদিও বিষয়টি এখন আর মজা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেলফি নিয়ে সত্যি আমাদের সিরিয়াস হতে হবে।এই সর্বনাশা ঘাতক ব্যাধি থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার : লেখক, কলামিস্ট।
chiroranjan@gmail.com