খবর কম ছাপাও, সব ঠিক হয়ে যাবে : নায়করাজ রাজ্জাক

 In বিনোদন, সফল মানুষ

‘খবর কম ছাপাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’

নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৬৪ সালে জীবিকার তাগিদে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বিভিন্ন ছবিতে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করার পর ১৯৬৬ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’তে নায়ক হিসেবে অভিষেক হয় তার। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি।

জীবন্ত এ কিংবদন্তি ‘শুটার’-এর প্রাক-মুক্তি ও ‘বারুদ’ সিনেমার নাম ঘোষণা অনুষ্ঠানে কয়েক মাস পর বৃহস্পতিবার এসেছিলেন প্রিয় কর্মস্থল বিএফডিসিতে। ওই আয়োজনের এক ফাঁকে শারীরিক অবস্থা ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত-বর্তমান নিয়ে তার সাথে কথা হয়।

কয়েক মাস পর এফডিসিতে এলেন। কেমন আছেন?
ষাট বছর ধরে পরিশ্রম করেছি, এখন বিশ্রামে আছি। শারীরিক দিক থেকে ভাল আছি, সুস্থ আছি। কিন্তু মানসিকভাবে ভাল নেই। ঈদের ছবি রমরমা ব্যবসা করার কথা, এখন তো ছবি চলেই না। সেদিক থেকে আমি ভাল নেই। যে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছিলাম— মারামারি, হানাহানি চলছে। চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে হলে সবাইকে একসাথে যুদ্ধ করতে হবে। আমি ইন্ডাস্ট্রির জন্য সবার কাছে দোয়া চাইছি— এ ইন্ডাস্ট্রি যেন আবার আগের মত ভাল হয়। আজকে আমাদের শিল্পী, টেকনিশিয়ানরা দুরাবস্থায় আছে। তাদের জন্য কিছু করা উচিত। এখন যেহেতু একটু সুস্থ হয়েছি, দেখা যাক ইন্ডাস্ট্রির জন্য কিছু করতে পারি কিনা।

চলচ্চিত্র বিষয়ক সরকারি বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণ কমিটি ও সভাতে ছিলেন বহুদিন ধরে। এ মুহূর্তে যে সকল সিদ্ধান্ত হচ্ছে তার সবই কি আমাদের ভালোর জন্য হচ্ছে?
শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক আন্তরিক। সর্বশেষ ইফতারিতে যখন দেখা হল তখন বললেন, ‘কী হচ্ছে? আপনারা (সরকারি বরাদ্দের) টাকা খরচ করতে পারছেন না। টাকা ফেরত আসে।’ তারপর বললেন, ‘আপনারা আসেন। দেখি আমি কী করতে পারি।’ এখন আমি তো একা যেতে পারি না। (অন্যদের) বলেছিলাম, চলেন আমরা একটা দল মিলে যাই। সরকারি টাকা দিয়ে তো একটা পুরো ইন্ডাস্ট্রি চালানো যাবে না। এফডিসি একসময় প্রযোজকদের তেমন কোন সুবিধাই দিত না। জমি-জমা বন্ধক, ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে ছবি মুক্তি দিতাম। এখন তো সরকার অনুদান দিচ্ছে। আমি যেমন টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউটের পরিচালনা পর্ষদে আছি— অনেক ভাল কিছু হচ্ছে। সরকার দিতে চায়, আমরাই নিতে পারছি না।

আপনি বলছেন আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে।
হ্যাঁ, মিডিয়ারও সহযোগিতা লাগবে। আমাদের সময়ে বাঘা বাঘা সাংবাদিকরা কাজ করতেন। একটু ভুল করলে ছাড় দিতেন না। আমার জীবনে চারটা ছবি সিলভার জুবিলি (টানা ২৫ সপ্তাহ চলা) হওয়ার পর সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’তে ছোট্ট করে সংবাদ ছাপা হয়েছে।

আপনাকে ‘নায়করাজ’ উপাধি দিয়েছিলেন চিত্রালীর সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরী।
উনিসহ সাংবাদিক নেতারা মিলে দিয়েছিলেন। তখন সাংবাদিকরা তাদের কাজের জন্য আমাদের পেছনে লাগতেন; আবার আমাদের অনেক ‘ফেভার’ও করতেন। আমার পিছনে জোঁকের মত লেগে থাকতেন পাকড়াও করার জন্য। পারে নাই, কারণ আমি ইন্ডাস্ট্রিকে ভালবাসতাম। আমার সাথে আহমেদ জামান চৌধুরীর ঝগড়াও হয়েছে, আবার দুজন গলাগলি করে হাঁটতাম। এদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, এরাই আমাকে গড়েছেন। আমাদের আমলে আধাঘণ্টা দেরিতে এলে সংবাদ হত। আর এখন তো ছয়ঘণ্টা দেরিতে এলেও সংবাদ হয় না। আপনি এসেছেন, ধন্যবাদ— এরকম হয়েছে ব্যাপারটা।

আপনারা সমালোচনা নিতে পারতেন?
আমার ওস্তাদ জহির রায়হান বলতেন— যখন আপনার নামে সাংবাদিকরা কিছু লিখবে না, বুঝবেন আপনার কোনো মূল্য নেই। তখনই একটা লোক আপনার বদনাম করবে, যখনই আপনি একটা কিছু হচ্ছেন। ওটাকে পুঁজি করে সামনে এগোতে হবে। সকালে পড়ে এসেছি, সেটে দেরি করে আসার খবর। লিখেছে কে? আহমেদ জামান চৌধুরী। তারপরও সেটে দেখা হওয়ার পর বলেছি, ‘আরে আসেন আসেন।’ এগুলো হজম করতে হয়। এখন কথায় কথায় তোমরা যাকে-তাকে সিংহাসনে বসাচ্ছো।

এখন পরিচালক-প্রযোজকরা প্রচুর নতুন ছেলে-মেয়েকে নায়ক-নায়িকা বানাচ্ছেন। কিন্তু এদের অধিকাংশই কথা বলতেই জানে না। আপনি কি মনে করেন এফডিসি বা শিল্পী সমিতি থেকে কোনো নীতিমালা করা দরকার?
না, এটা করতে হবে পরিচালকদের। নীতিমালা করে শিল্পী করা যায় না। উত্তম কুমারকে সেট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি মেধা দিয়ে প্রমাণ করেছেন নিজেকে। তারপর সহকারী পরিচালক হিসেবে ঢুকলাম ১৯৬৪ সালে। নায়ক হতে আসেনি কিন্তু, কাজ চেয়েছি শুধু। এখানে আসার আগে আড়াইশ’ নাটকে অভিনয় করেছি কলকাতায়। কিন্তু বলিনি কোনদিন। বলেছি, ‘ভাই আমাকে সুযোগ দেন।’ সুভাষ দত্তের ‘কাগজের নৌকা’র প্রোডাকশন ম্যানেজার ডেকে বললেন, ‘বাঈজী বাড়ির একটা পার্ট আছে করবেন?’ ঘুরে বেড়াচ্ছি, ডাক পড়ল— একটা পার্ট আছে, পিয়নের। করছি, কারণ আমাকে ঢুকতে হবে, পরিচালকের সাথে পরিচিত হতে হবে। নুর হোসেনের ছবি ‘কার বউ’ করছি। ‘ফেকু ওস্তাগার লেন’ করছি। আমার কোনো ইগো ছিল না। জহির রায়হানের সাথে আমার প্রথম থেকে পরিচয় ছিল। কথা দিয়েছিলেন— ব্রেক দেবেন, দিয়েছেন। ব্রেকটাকে আমি কাজে লাগিয়েছি। তারপরও আমি পাঁচ হাজার টাকার শিল্পী ছিলাম। তারপর তো পরিশ্রম করেছি, টাকা পেয়েছি। আজকে তো এসেই অনেক পেয়ে যাচ্ছে। বললাম না— সিংহভাগ দায়ী হচ্ছে মিডিয়া। খবর কম ছাপাও, দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে।

চলচ্চিত্রের কোনো সমিতিই তো এখন কার্যকর না। যার কারণে উন্নয়নই হচ্ছে না।
প্রযোজক সমিতির নির্বাচনের আগে আমার কাছে সব পক্ষ থেকেই লোকজন গিয়েছিল। আমি তাদের বললাম, ‘নির্বাচনে গিয়ে তোমাদের এ মুহূর্তে কাজ হবে না। তোমার ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিলেকশন যাও। মারামারি করবা না।’ তারা রাজিও হল। কিন্তু এর দশ-বারোদিন পর শুনি আবার মারামারি। তাহলে কিভাবে হবে? চলচ্চিত্রের স্বার্থে সবাইকে এক হতে হবে।

স্বাধীনতার পরে এফডিসির এমডি ছিলেন একজন আর্মি পারসন। শুটিং ফ্লোরের মেকআপ রুমের চেয়ারগুলো ভাঙা ছিল। আমি শাবানাকে নিয়ে একটা ভাঙ্গা চেয়ার হাতে এমডির রুমে গিয়ে বললাম, ‘আপনি এ চেয়ারটাই বসেন। আপনারটা আমি নিলাম।’ ভদ্রলোক খুবই লজ্জা পেলেন। এটা তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ছিল। এরপর দুইমাসের মধ্যে সকল ফ্লোর সংস্কার করেছিলেন।

আরেকটা ঘটনা বলি, ছোট্ট একটা কারণে এফডিসি থেকে আমার ছবির প্রিন্ট দিচ্ছিল না। সম্ভবত কোনো সমিতির সদস্য হয়নি, তাই। তখন এরশাদ সাহেব ক্ষমতায়। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমার ছবির প্রিন্ট কেন করাচ্ছে না আপনার এমডি। সে তো আমাদের টাকায় বেতন পায়।’ এরশাদ সাহেব বললেন, ‘ওকে। আমি দেখছি।’ তখন এমডি বলল, ‘আপনি আমাকে একবার বলতে পারতেন।’ আমি বললাম, ‘আমি কেন আপনার কাছে যাব?’ টাকা জমা নিলেন, প্রিন্ট দিলেন।

বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জোর করে আমরা হিন্দি ছবি আমদানি বন্ধ করিয়েছিলাম।

এখন তো অনেক প্রযোজক আমার কাছে এসে বলেন, অমুক তার ছবি আটকে দিচ্ছে। হল দিচ্ছে না। মেশিন দিয়েছে, হল নাকি তার। অনেকেই আজ গডফাদার হয়েছে, আমাদের সময়ে উর্দু গডফাদারদের সাথে যুদ্ধ করে ছবি করেছি। আপনারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেন, হল মালিককে মেশিন লাগাতে হবে। ভাড়া দিয়ে অন্যের মেশিনে আমরা ছবি চালাব না। সাহসটা করতে হবে।

যৌথ প্রযোজনা বিতর্ক হচ্ছে। সাফটা চুক্তি অনুযায়ী ছবি আমদানি-রফতানিও ব্যর্থ হচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে?
যৌথ প্রযোজনার নামে স্মাগলিং হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ার এটা হচ্ছে, এটা যৌথ প্রযোজনা না। যা হচ্ছে সবই বাকোয়াজ। আর ভারতীয় আমদানি রফতানি নিয়ে সমস্যা আছে। আমরা বাংলা ভাষাভাষী। কিন্তু ভারতে ভাষা আছে ৩৫টি। আমদানি-রফতানি করতে গেলে তারা বাংলা ছবি দেবে দুটো। বাকি সব হিন্দি, তামিল, তেলেগু মিলিয়ে দেবে।

আপনারা প্রবীণরা হাল ধরলে সমস্যা অনেকটা মিটত না?
আমদানি-রফতানি তো সরকারের ব্যাপার। আর আমাদের যৌথ প্রযোজনা কিংবা আমদানি রফতানিরও দরকার নেই। আমাদের এখানে যখন টেলিভিশন এল ‘রূপবান’ দিয়ে হল চালিয়েছি, ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ দিয়ে চালিয়েছি। মুখ থুবড়ে পড়া ইন্ডাস্ট্রির জন্য ‘বাবা কেন চাকর’ বানালাম। ‘মনপুরা’য় কোন অ্যাকশন আছে? চলল কিভাবে?

সরকারি অনুদান যা দিচ্ছে এটা কতটুকু যথাযথ?
এখন একটা ভাল ছবি করতে গেলে কমপক্ষে পঞ্চাশ লাখ টাকা লাগে। সরকারি অনুদান যেটা দিচ্ছে এটা ঠিক না। যাদের অনুদান দিচ্ছে এরা সবাই পরিচালকও না। অনুদানের বেশিরভাগ ছবিরই কাজ শেষ হয়নি, মুক্তি পায়নি।

অনুষ্ঠানস্থলে ঢোকার পরে আপনি বলছিলেন, এমন এফডিসি দেখতে চাই না। আপনার আক্ষেপটা কোথায়?
প্রত্যেকটা ফ্লোরে শিল্পী, কলাকুশলীরা কাজ করছেন— এটা যে কী আনন্দের, বলে বোঝানো যাবে না। আমি কিছুই দেখছি না। এখন তো সন্ধ্যার পরে ভুতুড়ে বাড়ি। আর আসি না এ জন্য— আমার সবসাময়িক অনেকেই এখন আর নেই। এখন যারা আছে সবার মন খারাপ, ছবি চলছে না। ল্যাবগুলো বন্ধ। বললাম না আমি টপ ফ্লোরে আছি, কিন্তু নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছি সব শূন্য।

আপনার এখনকার সময়গুলো কিভাবে কাটছে?
একটা টেলিফোন আর একটা মোবাইল আছে। আমার ডানে-বামে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই আজ নেই। তারপরও যারা আছে তাদের সাথে কথা বলি। এখনকার তরুণদের অনেকেই মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে যায়, আড্ডা মারে। আর একটা বেশির ভাগ সময় সিনেমা নিয়ে ‘ডিপপ্রেস’ থাকি। যেদিক যাচ্ছি সেদিকে হাহাকার!

Recent Posts

Leave a Comment