বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বস্তুটি ইদানিং রাজনীতির অঙ্গনে একটি মৃতসঞ্জীবনী বটিকা। এটা সেবন করে দুর্নীতির লাইফ সাপোর্ট থেকেও গা ঝাড়া দিয়ে উঠছেন রাজনীতিবিদরা। আকণ্ঠ অন্যায়ে নিমজ্জিত অনেকেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামক লাইফ জ্যাকেট জড়িয়ে দিব্যি ভেসে আছেন রাজনীতির ময়দানে।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বিষয়টা কি? কথা ছিল, এর উত্তরটা হবে খুবই সোজা, স্পষ্ট। কিন্তু না, এটাকে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর করা হয়েছে। রীতিমতো বায়বীয় করে ফেলা হয়েছে। অপব্যবহারে, অতি ব্যবহারে এটিকে ‘তেতো’ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যথারীতি এটা নিয়ে হাসাহাসি করারও একটা গোষ্ঠি তৈরি হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনগনের এবং এটি ছিল সর্বজনীন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুরও তাই সর্বজনীনতার সুর। কিন্তু ইতোমধ্যেই এটাকে বিশেষ গোষ্ঠির আবরণ ও আভরণে সজ্জিত ও দলীয় চেতনায় পরিণত করা হয়েছে। যে কোনো কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তকমাটা লাগিয়ে দিলেই স্বার্থটা ভালো উদ্ধার হয়, তাই যথেচ্ছাচারও হয়েছে। চেতনার বণিক যারা, তারা ঘটনার জন্য ওঁৎ পেতে থাকেন, তারপর সেটার মধ্যে প্রয়োজনানুসারে চেতনার রং পরিবেশন করেন। চেতনার তোড়ে অচেতন হয়ে অসংলগ্ন কথাও বলে বসেন।
হিন্দুদের ঘর-বাড়ি ভাঙ্গা হল। সঙ্গে সঙ্গেই বলা হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বলা হবে না, হিন্দুদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কারণ হিন্দুদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে এটা বললে ‘রাষ্ট্র তার নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে’ এই সত্য বেরিয়ে আসে। এটা অনেকটা ‘কথা সত্য মতলব খারাপ’ এর মতো।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে এটা বলার সুবিধাটা হল, যেহেতু সে নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সুতরাং সে নিজেই সেটা ভূলুন্ঠিত করতে পারে না। এটা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা রাজাকাররা। স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা রাজাকার কারা? যে যখন স্বঘোষিত এই চেতনা লালনকারীর বিরুদ্ধে কথা বলবে, সেই রাজাকার!
কেউ বলেন, রাষ্ট্রপরিচালনার চার মূলনীতি অর্থাৎ গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাই হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাহলে গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখানো একটি নির্বাচন কীভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার জন্য’ ট্যাগ দেয়া হল। অপরপক্ষও কম যায় না। তারা বলে, তারা নাকি মানুষ পুড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উদ্ধার(!) করার চেষ্টা করছেন। আমাদের ভাগ্য কিছুটা ভালো, জঙ্গীরা এখনও বলে নাই যে, তারাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার জন্য চাপাতি হাতে বেরিয়ে পড়েছে!
সোজা কথা হল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা এখন কুকর্মকে ‘ইনডেমনিটি’ করার মাধ্যম মাত্র। ফলে সঙ্কীর্ণ হতে হতে এখন প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে এর বোধ, আবেদন, শ্রদ্ধা, সম্মান।
একইসাথে ‘জামায়াত’ শব্দটাও রাজনীতির মাঠে এমন আরেকটি ব্র্যান্ড। যাকে তাকে, যখন তখন এই ট্যাগ দিয়েও ফায়দা হাসিল করা যায়। এই ট্যাগের লাইনে সেক্টর কমান্ডাররাও চলে এসেছেন, সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা কোন ছাই!
বোঝা দরকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে ‘শুধুমাত্র’ জামায়াতবিরোধিতা না। দেশের নদীখোর, জলাখোর, জঙ্গলখোর, পাহাড়-টিলাখোর, খনিখোর, গণতন্ত্রখোর, বাক-স্বাধীনতাখোররাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। কারণ, জনগণের অধিকার গ্রাস করার অধিকার একাত্তরের পরে কারো থাকবে না, এটাও মুক্তিযুদ্ধের আবশ্যিক চেতনা ছিল। এই চেতনা রক্ষার জন্যই আম জনতা প্রাণ দিয়েছিল।
চেতনান্ধরা মারাত্মকভাবে দু-মুখো। পাকিস্তান এবং জামায়াত শব্দদ্বয় উচ্চারণ করতে গেলে তাদের বমি বমি ভাব শুরু হয়। কিন্তু নিজেদের বেলায় সব হালাল। ইসলামি ব্যাংকের টাকা হালাল। এভাবে টিক্কার হ্যান্ডশেক, ভুট্টোর কাঁধ হালাল, জামাতের সাথে আমেদুধে মিশে সরকার নামানো হালাল, সংসদে একসঙ্গে বসা হালাল, যুদ্ধাপরাধীদের সাথে মেলামেশা হালাল, এমনকি তাদের সাথে পারিবারিক সম্পর্কও হালাল। এভাবে সুযোগ থাকার পরও জামায়াত নিষিদ্ধ না করা তাদের কাছে চেতনাপন্থী কাজ।
জামায়াতি পত্রিকায় লেখা লেখকদের তালিকা হয়েছে। দেখা গেল সেখানে আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুনের মতো ‘প্রগতিশীল’ মানুষেরা আছেন। ফ্যাসিবাদের একটা ধর্ম আছে। সেটা হল, ‘প্রতিপক্ষ’ ছাড়া ফ্যাসিবাদ টিকতে পারে না। সম্ভবত নামকাওয়াস্তে আধমরা একটা বিরোধীদল হওয়াতে সরকার এখন প্রতিপক্ষ সঙ্কটে পড়েছে। এই আকাল কাটাতেই তারা যাকে-তাকে রাজাকার বলছে, প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে।
পরিস্কারভাবে পাল্টা প্রশ্ন তোলা তুলতে হবে, কেন জামায়াত মালিকানাধীন পত্রিকায় লেখা যাবে না? একজন মুক্তিযোদ্ধা চাইলে জামায়াতের পত্রিকায় লিখতে পারবে আবার কোনো রাজাকার চাইলে একজন মুক্তিযোদ্ধার পত্রিকায় লিখতে পারবে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে এইসব ব্যাপারগুলি যাতে আমরা করতে পারি, সেজন্যই। রাষ্ট্রের যতটুকু সিদ্ধ সীমানা, ততটুকু পর্যন্ত একজন নাগরিক তার ইচ্ছানুযায়ী বিচরণ করবে। রাষ্ট্র যদি কোনো গোষ্ঠিকে তার জন্য হুমকি মনে করে তবে যথাযথ নিয়মে তাদের নিষিদ্ধ করুক। তারপর জনগণের কাছে পরিস্কার নির্দেশনা পৌঁছে দিক যে, এরা এখন থেকে নিষিদ্ধ, এদের সাথে এই এই করা যাবে আর এই এই করা যাবে না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো মানুষ যখন লেখেন, তখন তিনি তো নিশ্চয়ই পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাল মিলিয়ে আপস করে লেখেন না। রাজাকারের সাফাই গান না, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? তিনি তো তার কথাটাই লেখেন মাত্র। মার্কস-এঙ্গেলসও জীবনের বেশিরভাগ লেখা মার্কিন পুঁজিপতিদের পত্রিকায় ছেপেছিলেন কিংবা ছাপতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাতে তারা বুর্জোয়া হয়ে যাননি কিংবা পুঁজিবাদের দোসরও হয়ে যাননি।
চেতনান্ধরা চতুর বটে! তারা জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়াইটা সারতে চান শুধু ‘ঘৃণা’ দিয়েই। ‘ধরি মাছ ছুঁই না পানি’ প্রক্রিয়া। রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার কোনো পন্থা নেই, কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই।
শুধু ছি ছি শব্দ জামায়াতের কোনো নেতার সাথে কে কবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছে, কে সেলফি তুলেছে, জামায়াত নেতার কললিস্টে কার নম্বর পাওয়া গেছে, জামায়াতের বিশ্ববিদ্যালয়ে কে পড়ায়, জামায়াত নেতার লেখা বই কে পড়ে, জামায়াতের প্রতিষ্ঠানে কে চাকরি করে, জামায়াতের হাসপাতালে কে চিকিৎসা নেয়…। আর কিছুই না, এই প্রক্রিয়ায় জামায়াত শক্তিশালী হয় মাত্র।
চেতনান্ধদের চিন্তায় আর্যদের অস্পৃশ্যবাদের প্রভাব দেখা যায়। জামায়াতের সাথে এই করা সমস্যা, ঐ করা সমস্যা, হেন-তেন, আরও কত কী! তাদের মতে, জামাত >তারা মন্দ লোক> তারা অস্পৃশ্য>তুমি তার পত্রিকায় লিখেছ> তোমার জাত গেছে। তবে নিজেদের বেলায় ঠনঠন। তখন সবকিছুই ঠিক আছে এবং ঐ সবকিছুই করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার জন্য!
চেতনান্ধরা কিছুটা শিশুশুলভ, অবিকশিত মস্তিষ্কের। ‘জামায়াতের টাকা’ প্রপঞ্চটি ব্যবহার করে এরা প্রায়ই বলে, কারা এই টাকা খেয়েছে, সেটা তারা জানে। যদিও নিজেদেরটা বেমালুম চেপে যায়। এদেরকে কে বুঝাবে জামাতের টাকা বলে আলাদা কিছু নাই।
জামায়াতের কর্মীরা পকেটে যে টাকা নিয়ে ঘুরে সেটাতেও জাতির জনকের ছবি সাঁটানো আছে এবং লেখা আছে, ‘চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে।’ এরা ঘরে ঢুকে বলে, ছি ছি আপনার ঘরে পাকিস্তানি ফ্যান ঘুরছে কিংবা খেতে বসে বলবে, পাকিস্তানি কক আমি খাই না! এইসব চেতনার চৈতন্য দ্রুত ফিরে আসা জরুরী।
এখন চলছে ৫৭ ধারার যুগ। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বরখাস্ত হয়, শিক্ষার্থী আটক হয়। অথচ চারিদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয়জয়কার। নয় মাসের রক্তক্ষরণে কথা বলার এটুকু স্বাধীনতাও অর্জিত হয় নাই? ‘ফ্রিডম অব স্পিস’ কি একটা ইয়ার্কি? সেটা কোথায় থাকে?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে কি সেটার কোনো প্রকার সম্পর্ক নাই? সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, সরকারের কড়া সমালোচনা করার অর্থ সরকার অবমাননা নয়, দেশদ্রোহ তো নয়ই। এমনকি সরকারের কড়া সমালালোচনা করার জন্য রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও করতে পারে না।
এ ব্যাপারে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত দেশটির পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের সতর্ক করে দিয়েছে। আমাদের সরকার বাহাদুর কি সেটা জানে?
আজ যারা মনের আনন্দে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র দলীয় সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছেন, যাকে-তাকে জামায়াত ট্যাগ দেয়ার রাজনীতির জন্ম দিয়েছেন, তাদের মনে করিয়ে দেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কিন্তু প্রভু চিনে না।
সুতরাং সাধু সাবধান!
সাইদ রহমান : সাংবাদিক, কলামিস্ট।