গরীবের আর্তনাদ কেউ শোনেনা

 In জাতীয়, প্রধান খবর

গরীবের আর্তনাদ কেউ শোনেনা

টঙ্গির টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার বিস্ফোরণে আহত মনোয়ার হোসেন(৪৮) হাসপাতাল বেডে শুয়ে শুয়ে আর্তনাদ করে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ধনীদের সব কথাই সবাই শোনে কিন্তু গরীবের আর্তনাদ কেউ শোনেনা।

মনোয়ার জানান, ১৯৯৬ সালের ১৬ জুন থেকে এই কারখানায় কাজ করে আসছেন। একজন হেলপার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এখন তিনি সিনিয়র কাটিং মেশিন অপারেটর। চাকরি জীবনে এমন বিপদে পড়েননি কখনও।

ঐ দিনের ঘটনা স্মরণ করে গা শিহরিত হয়ে উঠে তার। তিনি বলেন, আমি সকাল ৬টার ৫ মিনিট আগে খাবার নিয়ে অফিসে প্রবেশ করি। খাবারটা রেখে অফিসের ভিতর মালামাল যেখানে লোড আনলোড করা হয় সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ হলো। সবাই যে যেভাবে পারে ছোটাছুটি করছে তখন আমিও দৌড় দেই। কিন্তু পরে কি হয়েছে আর বলতে পারিনা। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি আমি রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে পড়ে আছি। আমার পাশেও বেশ কয়েকজনকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু দাঁড়াতে পারছিলাম না। আমার সাড়া শরীরে স্প্লিন্টারের মতো অনেক কাচ ও লোহা জাতীয় কিছু জিনিস বিদ্ধ হয়ে আছে। আমার দুই পা ভেঙ্গে গেছে। তারপর আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

হাসপাতালে শুয়ে এই কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন তার স্ত্রী সন্তান, অফিসের বন্ধুরা অপলক দৃষ্টিতে শুধু তার দিকে চেয়ে রইলেন। মনোয়ার চোখের পানি ফেলে অন্যদেরও কাঁদিয়ে দিলেন।

তিনি বলেন, হাসপাতালে কখন এসেছি বলতে পারিনা। জ্ঞান ফিরলে আমি জানতে পারি আবিদা হাসপাতালে পঙ্গু হয়ে শুয়ে আছি।

সেখান থেকে ৩দিন পর টঙ্গি মডেল হাসপাতালে আসি। তিনি আরও বলেন, গত ২৬ সেপ্টেম্বর আমার বাম পায়ে ইকফেকশন দেখা দেওয়ায় তাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আবার ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিকেলে সিট না পাওয়ায় দুই রাত বারান্দায় থেকে টঙ্গির বাসায় চলে আসি।

তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমি সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী সন্তানদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না।

সরজমিনে দেখা যায়, তার সারা শরীরে অসংখ্য দাগ ও ছিদ্র। মনে হয় যেন প্লিন্টারের আঘাত। দুই পা প্লাস্টার করা।দাঁড়াতে পারেন না।

তার দুপা ভেঙ্গে যাওয়ায় কত বছর এভাবে থাকতে হয় বুঝতে পাচ্ছিনা।

কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার সংসারে আয় রোজগারের সেই ভরসা। সে এখন পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকলে সংসার কীভাবে চলবে আর তিনটা মেয়ে তাদের পড়াশোনার খরচ কে চালাবে? আমি এখন অকূল সাগরে পড়েছি। থাকা খাওয়া বাসা ভাড়ার খরচ কীভাবে দিব?

মনোয়ার হোসেন বলেন, আমার ২১ বছরের চাকরি জীবনে যে টাকা সঞ্চয় করেছিলাম তা আমার পরিবারের পিছনে খরচ করেছি। আমার স্ত্রী ৪/৫ বছর মানসিক রোগে ছিলেন। তাকে সুস্থ করে তুলতে সব টাকা খরচ করেছি। এখন আমার কাছে কিছুই নাই। আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কি করব বুঝতে পারছিনা। আমার ১৪ হাজার টাকা ঋণও রয়েছে।

তিনি বলেন, কবে আমি সুস্থ হবো সেটাও জানিনা। আমার মেয়দেরকে পিতা হিসেবে শিক্ষিত করার স্বপ্নও পূরণ করতে পারব না। সত্যি আমার মতো হতভাগা আর কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, অফিসে ৩ মাসের ওভার টাইমের টাকা পাওনা ছিল তাও পেলাম না। আমার জীবনে অন্ধকার অধ্যায় ছাড়া আর কিছুই রইল না। এতো বছর ধরে টাম্পাকোতে চাকরি করি এই বিপদের সময় একজন স্যার এসে খোঁজ খবর নিতে এলোনা। এখানে চাকরি করে চুল দাড়ি পাকা করছি।

তিনি বলেন কি বলব ভাই, গরীর বেঁচে থাকলেও কষ্ট করতে হয় মরে গেলেও তার উত্তরাধিকারীদের কষ্ট করতে হয়।

বড় লোকের আর্তনাদ সবাই শোনে গরীবের আর্তনাদ কেউ শোনেনা দেখেও না।

আজ টঙ্গির টাম্পাকো ফয়েল কারখানা ধ্বংসের এক মাস পূর্ণ হলো। যারা জীবিত আছেন, জীবিত থেকেও অসহনীয় জীবনযাপন করছেন। তাদের একজন মনোয়ার হোসেন। সর্বশেষ নিহতের সংখ্যা ৩৯, আহত ৩৫, নিখোঁজ ৯ ও অসনাক্ত ৮ জন।

Recent Posts

Leave a Comment