In শিল্প-সাহিত্য, সফল মানুষ

‘বাজে লেখকরা সংখ্যায় বেশি হয়’

মাসউদ আহমাদ / ৯:০০ অপরাহ্ন, অক্টোবর ১৬,২০১৬

‘বাজে লেখকরা সংখ্যায় বেশি হয়’

আনিসুল হক, কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক ও চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জনপ্রিয় ও ঈর্ষণীয় প্রতিভা। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দৈনিকটির প্রচার-প্রসার ও মানোন্নয়নে রেখেছেন প্রভূত ভূমিকা ।

 চেনা আনিসুল হকের বয়ানে অচেনা-অল্পচেনা-অজানা সত্ত্বা হাজির হয়েছে একান্ত এ আলাপচারিতায়।

বিস্তারিত জানাচ্ছেন তরুণ গল্পকার মাসউদ আহমাদ

লম্বা চুল, দাড়ি, পাঞ্জাবি, পূর্ণিমা রাত এসব কি কবিতার জন্য অবধারিত?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার ‘কবিতার ক্লাস’ বইয়ে তো বলেই দিয়েছেন লিখিতভাবে যে, কবিতা লেখার জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার দরকার নেই, লম্বা চুলের দরকার নেই, পাঞ্জাবির দরকার নেই। যেমন আমাদের জীবনানন্দ দাশ তো আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি এবং বাংলাভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি, তিনি বড় চুল বা বড় দাড়ি রাখেননি, বুদ্ধদেব বসু রাখেননি। আমাদের কালে শামসুর রাহমানের চুলটা লম্বা ছিল, দাড়ি ছিল না, তো সব মিলিয়ে কেউ যদি এসব রাখতে পারেন, যেমন রবীন্দ্রনাথ রাখতেন, নির্মলেন্দু গুণ রাখেন; রাখতে পারলে কিন্তু ভালোই। কবিদেরও একটা, কী বলব ব্র্যান্ড ইমেজ দরকার পড়ে। একজন কবি যখন হেঁটে যান লোকে যদি বোঝে যে সে কবি, সেটা খুব একটা দরকার যদি নাও হয়, কবির সারাক্ষণ নিজেকে বলতে হয় আমি কবি। আমাকে একবার কবি মহাদেব সাহা বলেছিলেন, এই যে আমি বড় বড় চুল রাখি, আমি কোনোদিন প্যান্ট শার্ট জুতা পরলাম না, ইন করলাম না এটারও কিন্তু একটা মূল্য আছে। আমি মনে করি যে, কবি নিজেকে সার্বক্ষণিকভাবে কবি ভাবছেন এবং সে জন্য তিনি একটা পোশাক পরছেন, একটা গেটাপ মেইনটেইন করছেন, অবয়ব বা ভাবমূর্তি রক্ষা করে চলছেন সেটাও মূল্যবান। যদিও ভালো কবিতা লেখার সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।

ছাত্রজীবনে কবিতার জন্য আপনি অনেক কসরত ও সাধনা করেছেন। একটু কবিসঙ্গ লাভের জন্য, একটু কবিতা নিয়ে আলাপ করার জন্য প্রায় প্রতি রাতে সোডিয়াম বাতির নিচ দিয়ে রাতের অন্ধকারে বুয়েট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল হেঁটে যাওয়া… বর্তমানে সেই কবির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো নয়?
ঐ জীবন তো মানুষ দ্বিতীয়বার ফিরে পাবে না। যে কোনো কবির ক্ষেত্রে সেটা সত্য। আমি বলি, কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং আবুল হাসান যখন তাদের ছাত্রাবস্থায় এই ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, হোটেলে ভাত খেয়ে পকেটে টাকা ছিল না বলে বের হয়ে দৌড় দিয়েছেন, সেই ঘটনাটা তো উনি এখন ঘটাবেন না, তাই না? আমার ক্ষেত্রে তেমন যখন আমি বুয়েটে পড়ছি, কবি হওয়ার চেষ্টা করছি, হেঁটে হেঁটে অন্ধকারে, তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে প্রায়ই কারফিউ হতো, জরুরি অবস্থা হতো, হল ভ্যাকান্ট হতো সেসবের মধ্য দিয়ে একা একা নিয়ন বাতি বা তখন সোডিয়াম বাতি এসে গেছে, তার নিচ দিয়ে হাঁটছি, সেসব সময়ে আমার নিজেকে কবি মনে হতো। কবির পক্ষেই সম্ভব এসব নির্জন রাস্তায়, যেখানে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে আর একটি লোক কবিতা লিখবে বলে একা একা আরেকজন কবির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে, সেই ইমেজটা আপনি আর আমার মধ্যে পাবেন না। বয়স, পেশা, সময়, সংসার আপনাকে আর ঐ জীবনে ফিরে যেতে দেবে না। এগুলো নিয়ে আপনি আফসোস করতে পারবেন। কিছু করার নেই।

প্রথম আলো প্রকাশের পর থেকেই আপনার দুটি কলাম ছাপা হয় : গদ্যকার্টুন ও অরণ্যে রোদন। সেখানে লেখক পরিচিতিতে আগে আপনি লিখতেন : কবি, সাংবাদিক ও লেখক। কিন্তু এখন লেখেন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। আপনি কবি পরিচয় নিয়ে কি দ্বিধান্বিত?
নারে, এটা হচ্ছে যে, সাহিত্যিক বললে তো পুরোটা কাভার করে। নাহলে আবার লিখতে হবে কবি, নাট্যকার, ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কলাম লেখক, সাহিত্য সমালোচক। এতো কিছুর দরকার নেই। সাহিত্যিক বললে সবই বোঝা যায়। তাই আমি জায়গা বাঁচানোর জন্য এই পরিচয়টাকে মেনে নিয়েছি।

আপনার প্রথম উপন্যাস ‘ফাঁদ’ আলোচিত এবং ঐ বছরে প্রকাশিত সেরা উপন্যাস হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আখ্যা দিয়েছিলেন। ফাঁদ  কবে, কোথায় লেখা?
‘ফাঁদ’ লিখেছিলাম সাপ্তাহিক চলতিপত্রে, তারিখ মনে নেই। খুব সম্ভবত ১৯৯৬ সালে লিখি এবং ৯৭-এর বইমেলায় বেরোয়।

আপনার ‘বেকারত্বের দিনগুলিতে প্রেম’ কি নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস?
এটাকে নিরীক্ষা বলবে কিনা আমি জানি না। নিরীক্ষাটা প্রধানত হয় ভাষার ক্ষেত্রে, প্রকরণের ক্ষেত্রে; বিষয় দিয়ে সাধারণত নিরীক্ষা হয় না। আমি যেটা করেছি, সেটা তো বিষয়ে, ফলে এটাকে নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস বলাটা বাড়াবাড়ি হবে। বিনয়ের অভাবে হবে। কিন্তু আমার লেখালেখি ভালো হোক মন্দ হোক, আমি চেষ্টা করি নিজের মতো লিখতে। আমি চেষ্টা করি একই জিনিস বারবার না লিখতে। একটা উপন্যাসের ফর্ম আমি পেয়ে গেলাম, ওটাই আমি বারবার লিখব- তা নয়, ওটা আমি বর্জন করার চেষ্টা করি, পারি কিনা জানি না।

ফাঁদ, খেয়া, অন্ধকারের একশ বছর পড়লে মনে হয় সিরিয়াস কথাসাহিত্যিক হিসেবে আপনার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাই জনপ্রিয় বা পপুলার রাইটার হিসেবে?
এটা তো তোমাদের দোষ, আমার দোষ না, আমার বিধিলিপি। তুমি আমার ‘ক্ষুধা এবং ভালোবাসার গল্প’, ‘বৃষ্টিবন্ধু’, ‘মা’, ‘আমার একটা দুঃখ আছে’, নিধুয়া পাথার’, ‘চিয়ারি বা বুদু ওরাওঁ কেন দেশত্যাগ করেছিল’ পড়ে যদি মনে কর আমি জনপ্রিয়, আমি কী করব?

আপনি বলে থাকেন, উপন্যাস বা অন্য সাহিত্য লেখক একা সৃষ্টি করেন না, সমাজব্যবস্থাও তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। কীভাবে?
লেখক তার সময়ের সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ এখন জন্মগ্রহণ করলে এই রবীন্দ্রনাথ হতেন না। তিনি তার সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই তেমন লিখতে পেরেছেন। এভাবে জীবনানন্দ দাশও। আমাদের সময়ে কেন মহাকাব্য রচিত হয় না, কারণ আমাদের সময় মহাকাব্যকে ধারণ করতে পারে না। আগে মহাকাব্য হতো। এর একটা কারণ ছাপাখানা ছিল না বলে সেটা ছন্দে লেখা হতো, যাতে লোকেরা মুখস্থ রাখতে সুবিধা হয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, মহাকাব্যে বাইরের বর্ণনা থাকে। যেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ তার সঙ্গে নায়ক বা নায়িকা, পাত্রপাত্রীরা কী করছে তার বর্ণনা আছে। কিন্তু হৃদয়ের ভেতর কী হচ্ছে তার বর্ণনা কম। এটা নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ অন্যরা বলেছেন, তখনো ব্যক্তি ব্যক্তি হয়ে ওঠেনি, তখনও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এ কারণে আগে উপন্যাস তৈরি হয়নি। উপন্যাসে ব্যক্তির হৃদয়ের ভেতরটা লাগে। ফলে একজন লেখক তার সময়েরই সৃষ্টি।

ব্যক্তি বা সমাজজীবনে মিডিয়ার প্রভাব প্রকট, কিন্তু সাহিত্য তেমন প্রভাব ফেলছে না। আগে দেখা যেত, উপন্যাসের নায়কের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেমন চুল আঁচড়ানোর স্টাইল, চশমা পরা ইত্যাদি প্রভাব ফেলত। এখন সে রকম দেখা যায় না। কেন?
আমাদের পোশাক-আশাক, ফ্যাশনটা গল্প উপন্যাস দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছে, এমন নয়। বরং চলচ্চিত্র আসার পরে চলচ্চিত্রের প্রভাবটা সবকিছুতে বেশি পড়েছে। আমাদের সাহিত্যের প্রভাবটা কীভাবে পড়ে : নীরদচন্দ্র চৌধুরী যেমনটা বলেছেন যে, বাঙালি আগে প্রেম করতে জানতো না, বঙ্কিমচন্দ্র তাকে প্রেম করতে শিখিয়েছে। তার উপন্যাসে প্রেম আসার পরে, তার আগে মানুষ আকুল হয়েছে সত্য, কিন্তু সেটা ঠিক রোমান্টিক প্রেম নয়, বাঙালি রোমান্টিকতা শিখেছে বঙ্কিমচন্দ্রের বই পড়ে। লেখকরা মানুষের ভাবনার জগৎকে নির্ধারণ করে দিতে পারেন, পাল্টে দিতে পারেন, এটা যুগে যুগে হয়েছে। আমরা শুনেছি যে, ফেরদৌসীর শাহনামা ইরান জাতিকে জাগিয়েছিলো, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেখেছি সাহিত্য কীভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সেসবের প্রভাব এখনো আছে। এখনেও রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষকে ভাবায়, কাঁদায়। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে ছেলেমেয়েরা হিমু হওয়ার চেষ্টা করে। তারাশঙ্করের কবি পড়ে ছেলেমেয়েরা প্রেমের জন্য আকুল হয়।

এখন যেসব গল্প-উপন্যাস লেখা হয়, বেশিরভাগই হালকা লেখা, গভীরতা কম; জীবনের গভীর উপলব্ধি তেমন আসছে না?
এটা এখন আর তখনের ব্যাপার নয়, এটা সব দেশে সব সময় সত্য, উৎকৃষ্ট সাহিত্য বেশি পরিমাণে হয় না। উৎকৃষ্ট সাহিত্যিকের সংখ্যাও বেশি হয় না। পাতার সংখ্যা সবসময় ফুলের সংখ্যার চেয়ে বেশি হয়। আবার সব ফুল থেকে ফল হয় না। এটা নিয়ে আফসোস করার কিছু নাই। বঙ্কিম, মানিকের কালেও অনেক বাজে লেখক ছিল। বাজে লেখকরা সংখ্যায় বেশিই হয়।

গল্প-উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে উপাদান সংগ্রহের জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে আপনি কতটুকু গুরুত্ব দেন?
হাসান আজিজুল হক স্যার একবার আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, ‘আমি বানিয়ে গল্প লিখতে পারি না।’ স্যার হয়তো বিনয় করে বলেছিলেন, ‘বাস্তবতাটা যা চোখে দেখি সেটার বর্ণনা দিয়ে আমার বানানোর অক্ষমতাকে ভরিয়ে তুলতে চাই।’ এটা হাসান স্যারের কথা। তাঁর বানাতে পারি না কথাটাকে বাদ দিয়ে বাস্তবতার বর্ণনা দিয়ে জায়গাগুলোকে ভরিয়ে তুলি- এই কথাটা তুমি নিতে পারো। দেখবে যে, এক জায়গায় বসে আছেন তার চারপাশের বর্ণনাটুকু উনি খুব সুন্দর করে দেন। তার আত্মজীবনীর যে বইটি বেরিয়েছে, দেখবে যে শুধু বর্ণনা। সেই রাঢ়বঙ্গের বর্ণনা। তো বাস্তবতার ভেতর থেকে সবকিছু আসে, যত বড় গল্প কাহিনীই হোক না কেন। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল যে সায়েন্স ফিকশন লেখেন, রোবটরা যুদ্ধ করছে, এটা তো কাল্পনিক, কিন্তু বর্ণনাটা বাস্তবতা থেকেই নেয়া। কল্পনা আকাশ ছুঁতে পারে, কিন্তু তার একটা বাস্তব জমিন থাকে। আমি মনে করি যে, বাস্তব অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি অনেক উপন্যাস লেখার জন্য সে এলাকায় চলে গিয়ে, দেখে এসে তারপর লিখেছি।

আপনি একটি ট্রিলজি লিখছেন। এর দুটি খণ্ড বেরিয়ে গেছে। ‘যারা ভোর এনেছিল’ এর প্রথম পর্ব। এতে প্রধানতম চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপন্যাসে তাকে সাধারণ উপন্যাসের নায়কের মতো নির্মাণ করেছেন। এমন একটি চরিত্র নিয়ে কাজ করার প্রেরণা কীভাবে পেলেন?
আমি মনে করি যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে লেখা যায়। লেখা উচিৎ। দেখা যাক, যদি ভালো হয় তাহলে আমার শ্রমটা সার্থক হবে। আর যদি ব্যর্থ হই তাহলে তো কিছু করার নেই। তুমি অনেক উচ্চাভিলাষী কাজ নিয়েও ব্যর্থ হতে পারো। পরিশ্রম করলে, সব ঠিক আছে, দেখা গেলো কোথাও লবণটা কম হয়েছে, জিনিসটা দাঁড়ালো না। শিল্প সবসময় অনিশ্চিত। তুমি জানো না, ব্যর্থ হবে না সফল হবে।

আপনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সরাসরি দেখেছেন?
বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখিনি।

মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বা ইতিহাসের ঘটনার আশ্রয়ে উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে একজন উপন্যাসিকের সামনে প্রধান ঝুঁকি কী বলে মনে করেন?
ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে অনেক উপন্যাস লেখা হয়েছে। বাংলা ভাষায় বাংলাদেশে তো হয়েছেই। সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি। এটার ঝুঁকি অন্য যে কোনো সাহিত্যকর্মের যে ঝুঁকি এসবেরও একই ঝুঁকি। তুমি সফল হতে পারো, ব্যর্থও হতে পারো। সাহিত্যিক কতগুলো বিপদ তৈরি হতে পারে, হয়তো লোকে বলতে শুরু করল, এই উপন্যাসে ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। সবসময় ঔপন্যাসিক উপন্যাসে ইতিহাস উপস্থাপন করতে নাও চাইতে পারেন। ইতিহাস সবসময় যিনি লেখেন তার ব্যাখ্যা, ঘটনা, ঘটে যাওয়া অতীতের ঘটনা নিয়ে একাধিক মানুষের বর্ণনা। কাজেই ইতিহাস নিজেই যে সবসময় একটা নিরপেক্ষ জিনিস, তা নয়। পরাজিতের ইতিহাস এবং বিজয়ীর ইতিহাস এক নয়। আবার ঔপন্যাসিক যখন উপন্যাস লেখেন তখন উপন্যাসে নিজের ব্যাখ্যাটা দাঁড় করান। কাজেই ঔপন্যাসিকের এই দায়টা নেই যে, তাকে ঐতিহাসিকভাবে নির্ভুল হতে হবে। ঔপন্যাসিকের একটা কাজ হচ্ছে তার চরিত্রের হৃদয়ের কথা বলা। একজন সাংবাদিক বা একজন ঐতিহাসিক যখন ঘটনার বর্ণনা দেন, তিনি কিন্তু বলতে পারবেন না ঐ সময় চরিত্রটি কী ভাবছিল। কিন্তু উপন্যাসের কাজই হচ্ছে মনের বর্ণনা দেয়া। তিনি সেই স্বাধীনতাটা রাখেন। কাজেই আমি কোনো ঝুঁকি দেখি না। ঝুঁকিটা হচ্ছে শিল্পের ঝুঁকি, শৈল্পিক ঝুঁকি। তবে এমন লেখায় পরিশ্রম বেশি। এখন আমি যেহেতু ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে লিখছি, যদি এমন লিখি যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের করাচিতে ছিলেন, তাহলে লোকজন তা মানবে না। কারণ আমাকে বলতেই হবে যে, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিতে এসেছিলেন, তাই না। কাজেই আমাকে জানতেই হচ্ছে যে, ৭ মার্চ তিনি কী করেছিলেন। তিনি কী পোশাক পরে এসেছিলেন, তিনি কোন গাড়ি চড়ে এসেছিলেন, তার চোখের চশমাটা কেমন ছিলো, তার হাতে পাইপ ছিলো কিনা, এগুলো আমাকে জানতে যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে। খাটুনি বেড়ে গেছে, এই ঝুঁকিটা আছে।

‘মা’ আপনার অন্যতম সৃজনশীল কাজ, যেটি মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাসে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে উপন্যাস। বইটির  ৬২তম সংস্করণ চলছে?
সর্বাধিক সংখ্যক মুদ্রণ ঘটেছে তার মানে এই নয় যে, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের প্রতি মুদ্রণের সংখ্যা আমার চেয়ে বেশি। কিন্তু এই বইটি হুমায়ূন স্যারের জনপ্রিয় বইগুলির কাছাকাছি বা অল্পকিছু কম।

মা কে উপন্যাস হিসেবে লিখতে শুরু করলেন কখন? আর লিখলেন কতদিন ধরে?
প্রথমে এক বছর ধরে কাহিনিটা তাড়া করে ফিরছিলো। নাসিউদ্দিন ইউসুফ আমাকে ২০০১ সালে গল্পটা বলেছিলেন। উনি বললেন, একটা নাটক লিখে দাও। আমি বললাম, না, এটা নিয়ে ভালো কিছু করতে চাই। তারপর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম যে আমি শহীদ আজাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। এরপর অনেক লোকের সাক্ষাৎকার নিতে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। নানান পর্যায়ে লিখেছি। একবার লিখেছি, আবার লিখেছি। বারবার লিখেছি। এভাবে প্রায় বছর খানিক লেগেছে।

 

আপনার নিজের ভাষ্য ‘মা’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আমি একটু কম স্বাধীনতা পেয়েছি। কারণ বেশিরভাগ চরিত্র বেঁচে আছেন। যারা আমাকে তথ্য দিয়েছেন তাদের প্রত্যাশারও একটা চাপ আছে। এটা কি উপন্যাস নাকি ডকুমেন্টারি?
শাহাদত চৌধুরী, আমার শ্রদ্ধেয় সম্পাদক, আমার সোর্স, খুব উৎসাহিত করেছেন। তিনি এটার নাম দিয়েছিলেন ডকুফিকশন। এটি একটি প্রামাণ্য উপন্যাস। উপন্যাসে কী হয় উপন্যাসে মনের বর্ণনা দিতে হয়, সংলাপ এবং বাইরের ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা দিতে হয়। মনের বর্ণনা তো আমি বানিয়ে দিয়েছি। বাইরের বর্ণনাটা যখন লিখছি আকাশে মেঘ, জোনাক জ্বলছে, বাতাস বইছে এগুলি বাস্তবে হয়েছে কি হয়নি আমি জানি না।

মা উপন্যাস সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, আমার কাছে এখন দুই মা : ম্যাক্সিম গোর্কির মা এবং আনিসুল হকের মা, দুই মা-ই যথার্থ হয়ে উঠেছে। সরদার স্যারের এই বিবেচনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আমি খুশি হয়েছি নিশ্চয়ই, আসলে সমালোচকদের কথাকে এভাবে মূল্যায়ন করার দরকার নেই। তার মানে এই নয় যে, উনি আনিসুল হককে ম্যাক্সিম গোর্কির সাথে তুলনা করেছেন। উনি যেটা বলেছেন, তিনি তো একসময় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন, একটা সময় ম্যাক্সিম গোর্কির মা তাদের অবশ্য পাঠ্য ছিলো। পরবর্তীকালে তিনি জীবনের শেষভাগে এসে আমার বইটি পেলেন, ফলে তিনি মনে করেছেন যে, এটা সবার পড়া উচিৎ। এইভাবে। অন্য কোনোভাবে নয়।

মা উপন্যাসকে আপনার শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর অন্যতম বিবেচনা করেন কি?
শ্রেষ্ঠ-ট্রেষ্ঠ পরেই বলি, আমার মরার পরে না হয় এটা বিবেচনা করা যাবে। আমি মায়েদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, মুক্তিযুদ্ধে আমরা কতটা ত্যাগের ভেতর দিয়ে গেছি এ কথা মানুষদের জানানো দরকার। জানালে তুমি যেটা অনেক কষ্টে পাওয়া ধন সেটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করবে। মুক্তিযুদ্ধের যে মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক ন্যায় বিচার বা সাম্য, জাতীয়তাবাদ-এগুলো বিসর্জন দেয়ার মতো জিনিস নয়। সে কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়ার জন্য আমি মায়ের কথা বলি। পড়তে বলি। গল্প বা উপন্যাস পড়লে তো ব্যক্তিমানুষের কাহিনী পড়ো, সহজেই একাত্ম হয়ে পড়ো। মা পড়ে এমন একাত্ম হওয়া যায়। মা উপন্যাসের জন্য প্রতিদিন ফোন পাই, চিঠি পাই, মেইল পাই। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলো পুরুজ্জীবিত করতে বা ধরে রাখতে মা বইটা বা যে কোনো বই যদি অবদান রাখে, সেটার গুরুত্ব আছে।

লিটল ম্যাগাজিন ‘লোক’ আয়োজিত এক বৈঠকীতে আহমাদ মোস্তফা কামাল, অদিতি ফাল্গুনী, মাহবুব মোর্শেদের মত তরুণ গল্পকাররা মা-কে এক ধরনের ফাঁদ বা স্ট্যান্টবাজি হিসেবে অভিহিত করেছেন। একজন এও বলেছেন, সরদার স্যার উপন্যাসের বোঝেন কী? এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
আমি এটা পড়িনি। বলতে পারছি না।

এই সুযোগে আপনার মা মোসাম্মাৎ আনোয়ারা বেগম, তার কথা কিছু বলুন!
আমার আসলে দুই মা। বড় আম্মা এবং ছোট আম্মা। আনোয়ারা বেগম তাঁকে আমরা ছোট আম্মা বলে ডাকতাম। আর বড় আম্মা, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। নিঃসন্তান থাকার কারণে বড় আম্মার অনুমতি নিয়ে আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বড় আম্মা, ছোট আম্মা, আমরা পিঠাপিঠি ৫ ভাই-বোন সবাই এক বাড়িতে আনন্দে সময় কাটিয়েছি। হয়ত আমার নিজের আম্মা প্রেগন্যান্ট, বাকি বাচ্চাদের বড় আম্মা সরষের তেল মাখাচ্ছেন, গোসল করাচ্ছেন, এসব কথা খুব মনে পড়ে। আর ছোট আম্মা হচ্ছেন অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। আম্মা বেঁচে আছেন, রংপুরে থাকেন। এমন মা বাংলাদেশে হতে পারে তা কল্পনা করা যায় না। মায়ের যেমন কোমল স্বভাব থাকে, মানুষ মায়ের আঁচলের নিচে বড় হয়, দূরে গেলে মা কাঁদে, ফিরে আসতে বলে, বিপদের মধ্যে মা সন্তানকে ঠেলে দেয় না, আমার আম্মা এরকম না। আমার আম্মার নির্দেশ ছিল যে, প্রত্যেকটা ছেলেকে সাঁতার কাটতে জানতে হবে, সাইকেলে চড়তে পারতে হবে এবং গাছে চড়া শিখতে হবে। ফলে আমি ছোটবেলায় নদীতে কিভাবে সাঁতার শিখেছি আমি জানিও না। আমার মেজভাই একবার কানাডা গেল, খুব কান্নাকাটি করত, চলে আসতে চাইত। আম্মা বলতেন, না তুমি আসতে পারবা না, পিএইচডি না করে তুমি আসতে পারবা না। আমার আম্মা এ-রকম। ছোটবেলায় আমাদেরকে বৃত্তি পেতে হবে, স্ট্যান্ড করতে হবে, এই লাইনে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। পড়াতেন নিজে এবং পিটিয়ে পিটিয়ে পড়াতেন। এর ফলে আমার বড় ভাই বৃত্তি পেল এবং স্ট্যান্ড করল। এবং আমার সব ভাই-বোনদের বেলাতেই বৃত্তি পাওয়া ও স্ট্যান্ড করা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমাদের ভাই-বোনেরা যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হলো, তাতে আসলে আমার আম্মার অবদানই বেশি। মায়ের কোমল স্বভাবটা আমরা অন্যদিকে পেয়েছি আব্বার কাছে। আমাদের যেটা আবদার ছিল, সেটা আব্বার কাছে।

Recent Posts

Leave a Comment