পাহারাদার খুন; দুই দিনেও ধরা পড়েনি কেউ, জনমনে আতঙ্ক!

 In চাঁদপুর, দেশের ভেতর, প্রধান খবর, লিড নিউজ

 

চাঁদপুর প্রতিনিধিঃ
চাঁদপুর শহরের ট্রাক রোড এলাকায় সেবা আয়েশা গার্ডেন নামের একটি বহুতল ভবনের কেয়ারটেকার দেলোয়ার হোসেন (৫৮) কে জবাই করে খুন করার ঘটনার পর চাঁদপুর শহরের সাধারণ মানুষের ভেতর ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ওই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের পর ৪৮ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনো পর্যন্ত খুনীদের কাউকে গ্রেফতার করতে সক্ষম না হওয়ায় সাধারণ মানুষ হতাশা ব্যক্ত করেছে। রোববার দিবাগত রাতের কোন এক সময় দেলোয়ারের হাত-পা বেঁধে তাকে নৃশংসভাবে খুন করে ভবনের নিচতলার গ্যারেজ থেকে চারটি মোটর সাইকেল নিয়ে যায় দুর্বৃৃত্তরা। নিহত দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি মতলব পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডস্থ দিঘলদী গ্রামে। তিনি এই ভবনে ৮/৯ মাস যাবৎ কেয়ারটেকার হিসেবে চাকুরি করছিলেন। গোয়েন্দা পুলিশ অবশ্য সোমবার দুপুরে চাঁদপুর শহরতলীর আশিকাঠি এলাকায় অবস্থিত জেলা কারাগারের পাশের একটি সড়ক থেকে চুরি যাওয়া হোন্ডার একটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে। মঙ্গলবার পুলিশ ওই এলাকায় আরো তল্লাশি চালালেও খুনীদের কাউকে ধরতে সক্ষম হয়নি। উদ্ধার করা যায়নি আর কোন মটর সাইকেলও।
সেবা আয়েশা গার্ডেন নামে নয়তলা বিশিষ্ট এই বহুতল ভবনটির মূল কাজ শেষ হলেও আনুষঙ্গিক কিছু কাজ এখনো বাকি রয়েছে। ভবনে কোন লিফট্ না থাকায় উপরের দিকের ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি হচ্ছে না বলে জানা যায়। এই ভবনের দ্বিতীয় তলায় এয়ারটেল সিম কোম্পানীর কাস্টমার কেয়ার অফিস। অন্যান্য ফ্ল্যাটের মধ্যে কিছু ফ্ল্যাট বিক্রি হয়, কিছু ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া রয়েছে এবং কিছু ফ্ল্যাট এখনো অসম্পূর্ণ অবস্থায় খালি রয়েছে। এই ভবনের নিচতলা পুরোটাই গাড়ির গ্যারেজ। এই গ্যারেজের সামনের অংশে উত্তর পাশে একটি কক্ষে কেয়ারটেকার দেলোয়ার হোসেন থাকতো। ওই কক্ষেই দুর্বৃত্তরা তার হাত-পা বেঁধে জবাই করে খুন করে।
ঘটনাস্থল থেকে দু’টি ভাঙ্গা তালা আলামত হিসেবে উদ্ধার করা হয়। লাশের ময়নাতদন্ত শেষে সোমবারই বিকেলে তা পরিবারের সদস্যদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়েছে। রাতেই গ্রামের বাড়ি মতলবের দিঘলদীতে দেলোয়ারকে সমাহিত করা হয়েছে।
নিহত দেলোয়ারের ২ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে ছেলে আঃ মালেক (২৮) ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করেন বলে দেলোয়ারের স্ত্রী জোছনা বেগম (৫২) ও মেয়েরা জানান। দেলোয়ারের স্ত্রী জোছনা বেগম জানান, তার স্বামী ৬/৭ বছর সৌদি আরব ছিলেন। সেখান থেকে একেবারে দেশে চলে আসেন প্রায় চার বছর হবে। দেশে আসার পর তিনি অনেকটা বেকার ছিলেন। কিছুদিন পর ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চাকুরি নেন। সেখানে কয়েক বছর চাকুরি করার পর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে আসেন। গ্রামে অনেকদিন বেকার ছিলেন। এরপর ৮/৯ মাস হলো এখানে (সেবা আয়েশা গার্ডেন) চাকুরি নেন। এখানে বেতন ছয় হাজার টাকা করে পেতেন বলে স্ত্রী জোছনা বেগম জানান। থাকার জায়গা মালিকের পক্ষ থেকে দেয়া হলেও খাওয়া নিজের উপর ছিলে বলে তিনি জানান। আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো না থাকায় অল্প বেতন এবং কম সুযোগ সুবিধায়ও এ চাকুরি করতে বাধ্য হন তিনি। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহত দেলোয়ারের স্ত্রী বাদী হয়ে চাঁদপুর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।
নৃশংসতম এ হত্যাকা-ের পর ভোর বেলা ঘটনা প্রথম দেখেছেন এই ভবনের ৮ম তলার ফ্ল্যাটের মালিক সাইফুল ইসলাম। তিনি জানালেন যে চারটি মোটর সাইকেল চুরি হয়েছে তার একটির মালিক আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, সাইফুল ইসলাম ভোরে হাঁটতে বের হওয়ার জন্য নিচে নামেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে কেয়ারটেকার দেলোয়ার এর কক্ষের দিকে তাকিয়েই তিনি দেখেন দরজা খোলা এবং খাটের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় দেলোয়ার পড়ে আছে। আর খাটের সামনে ফ্লোরে অনেক রক্ত পড়ে আছে। তখনই ঘটনা জানাজানি হয় এবং চাঁদপুর মডেল থানায় ফোন দেয়া হয়। থানায় জানানোর পর থানা থেকে জানানো হয় নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর সিরাজুল মোস্তফাকে। তিনি আনুমানিক সকাল সাড়ে ৮টায় ঘটনাস্থলে যান। এরপর অন্যান্য পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে আসেন।
মোঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, এ ঘটনায় চারটি মোটর সাইকেল চুরি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তার নিজের একটি (বাজাজ কোম্পানীর পালসার), এই ভবনের একটি ফ্ল্যাটের মালিক মোঃ হাবিবের সুজুকি কোম্পানীর একটি, জনৈক রনির একটি (সুজুকি) ও ফয়সালের একটি (পালসার)। আবুল কালাম আজাদ জানান, এই চার মোটর সাইকেল মালিকের মধ্যে শুধু ফয়সাল এই ভবনে ভাড়া থাকেন। আর অন্য তিনজন আশপাশে অন্য বাসায় ভাড়া থাকেন। তারা তাদের মোটর সাইকেলের নিরাপত্তার স্বার্থে এখানে রাখেন। এই চার জনের মধ্যে হাবিব ফ্ল্যাটের মালিক হলেও পাশেই ভাড়া থাকেন। মোটর সাইকেল ছাড়া প্রাইভেট কারসহ অন্য গাড়িও এখানে রাখা হয়। মোটর সাইকেলের জন্য ভাড়া দিতে হয় কিনা তা না বললেও প্রাইভেটকারের জন্য মাসে ১ হাজার ২শ’ টাকা ভাড়া দিতে হয় বলে আবুল কালাম আজাদ জানান।
চাঁদপুর শহরের ট্রাক রোডে অবস্থিত সেবা আয়েশা গার্ডেন নামে নয়তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবনটি একেবারেই অরক্ষিত। নিরাপত্তার ছিটেফোঁটাও দেখা গেলো না ভবনটিতে। ভবনটির নিচতলার তিনদিক দিয়েই উপরের দিকে খোলা। আশপাশে রয়েছে টিনশেড অনেক বাসাবাড়ি। আবার ভবনের প্রধান ফটকের সাথে দক্ষিণ পাশে যে ছোট পকেট গেইটটি রয়েছে সেটির উচ্চতাও তেমন একটা বেশি নয়। এই গেইট টপকিয়ে এবং তিনদিকের দেয়ালের উপর যে ফাঁকা জায়গা রয়েছে, এদিক দিয়েও যে কোনো মানুষ ভেতরে ঢুকতে পারবে। তাছাড়া ভবনটিতে কোনো সিসি ক্যামেরাও নেই। এমন নিরাপত্তাহীন অরক্ষিত অবস্থা দেখে অনেকেই হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এখন জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দেলোয়ারকে খুন করা হলো কেনো? তাহলে কি দেলোয়ার দুর্বৃত্তদের দেখে চিনে ফেলেছিলো? দুর্বৃত্তরা হয়তো দেয়াল টপকে অথবা পকেট গেইট টপকে ভেতরে ঢুকেছে। মোটর সাইকেল নিতে হলে মেইন গেইট খুলতে হবে। কিন্তু গেইটে তালা লাগানো ছিলো। পুলিশ ভেতরে দুটি তালা ভাঙ্গা অবস্থায় পেয়েছে। তাহলে কি তালা ভাঙতে গিয়ে অথবা খুলতে গিয়ে কেয়ারটেকার দেলোয়ার হোসেন টের পেয়ে গিয়েছিলো? আর টের পাওয়ার পর দেলোয়ার কক্ষ থেকে বের হয়ে দৃর্বৃত্তদের দেখে হয়তো চিনে ফেলেছে। আর এ কারণেই হয়তো তারা নিজেদেরকে রক্ষার জন্যে দেলোয়ারকে জানে মেরে ফেলেছে। আর যদি তা না-ই হতো তাহলে দুর্বৃত্তরা দেলোয়ারকে হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে রাখতো। জানে মেরে ফেলতো না। দুর্বৃত্তদের চিনে ফেলায় এবং পরবর্তীতে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই হয়তো তারা দেলোয়ারকে মেরে ফেলেছে। আর তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে ওই দুর্বৃত্ত চক্র কি এলাকারই ? কারণ, দূরের হলে তো চিনার কথা না। আর না চিনলে তো তাকে এভাবে হাত-পা বেঁধে জবাই করে খুন করার কথা না। এসব নানা প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, জবাব, সন্দেহ এই খুনের ঘটনাকে ঘিরে জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে জনগণের বিশ্বাস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকস এবং কৌশলী কর্মকর্তাদের নিবিড় তদন্তে খুনি এই দুর্বৃৃত্ত চক্রের সন্ধান অবশ্যই বের হয়ে আসবে।
শান্তির শহর হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর শহরের মাঝামাঝি এলাকায় এমন একটি খুনের ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। শহরে পুলিশের টহল, কমিউনিটি পুলিশের তৎপরতার ভেতর দুর্বৃত্তরা কী ভাবে একজন মানুষ খুন করে চারটি মটর সাইকেল চুরি করে নিয়ে গেল- এমন প্রশ্ন এখন মানুষের মনে মনে। অবস্থার প্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে খুনীরা সংখ্যায় অবশ্যই চার বা তার চাইতে বেশি। তারা আগে থেকেই ভবনটি, কেয়ারটেকারের অবস্থান, হোন্ডার সংখ্যা, ভবনের বাসিন্দাদের সম্পর্কে যথেষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছিল। আর তাদের এই কাজে সহায়তা করে ওই ভবন বা আশ-পাশের কেউ। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুনীরা এসে তাদের অপারেশন চালিয়ে নিরাপদে সরে যায়।
চাঁদপুরে সাম্প্রতিক সময়ে মাদকের ব্যবহার বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ইয়াবা নামের প্রাণঘাতি নেশা দ্রব্যের ছোবলে আক্রান্ত হচ্ছে কিশোর-তরুণরা। পুলিশের মাদক বিরোধী অব্যাহত অভিযানের পরও ইয়াবা ব্যবসা ও সেবন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার মাদকের বিরুদ্ধে দস্তুরমত জিহাদ ঘোষণা করেছেন। তিনি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুড়ে মাদক বিরোধী সভা-সমাবেশ করছেন। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কিশোর-তরুণদের উদ্বুদ্ব করতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ফুটবল টুর্ণাসেন্টের পর্যন্ত আয়োজন করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। মাদকসেবীদের বাড়িতে যেয়ে তাদের সংশোধনের জন্য উদ্বুদ্ব করছেন। অভিবাবকদের নিয়ে সভা করছেন। মাদক বিরোধী র‌্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটিকা প্রদর্শণ, শপথ বাক্য পাঠ-ইত্যাদি নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে। তারপরও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। পাড়া-মহল্লা, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে এক শ্রেণীর কিশোর-তরুণ ইয়াবার ব্যবসা করছে। নদীর পাড়, রেল লাইনের পাশে, বসত বাড়িতে বসছে মাদকের আসর। আর এসব মাদক আসক্তরাই নেশার টাকা যোগাড় করতে যেয়ে নানা অপরাধ করে যাচ্ছে। চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় মটর সাইকেল চুরির ঘটনা ঘটছে। যে এলাকায় ওই খুনটি সংঘঠিত হয়েছে সে এলাকা থেকে এর আগেও বেশ কিছু মটর সাইকেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখিত কুনের ঘটনার সাথে মাদকসেবীদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

Recent Posts

Leave a Comment