উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে অর্থনীতি

 In জাতীয়, লিড নিউজ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

একদিকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু অন্যদিকে চরম অর্থ সংকট। এই দুই বিপরীতমুখী যাত্রায় বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে মারাত্মক করে তুলেছে

বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে স্থান পাওয়া কেবল দেশের অভ্যন্তরের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই বিচার হয় না। নানা সূচক, বিশেষ করে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং জিডিপির সূচক বিচার করে এ
যোগ্যতা নির্ধারণ হয়। তবে নিজস্ব অর্থনীতি দুর্বল অথবা ভঙ্গুর অবস্থায় থাকলে এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়বে এবং দেশের অভ্যন্তরে নানা অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। বতর্মান বাস্তবতায় বারবার সামনে চলে আসছে দেশের ব্যাংকগুলোতে বিদ্যমান অর্থ সংকট। কয়েক মাস ধরে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা, অর্থ সংকট, অর্থ পাচার ও লুটপাটের বিভিন্ন চিত্র প্রকাশ হওয়ার পর জনমনে দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা শঙ্কা কাজ করছে।

ব্যাংকগুলোতে টাকা না থাকার কারণে আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। নতুন ঋণ দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পড়ে গেছেন মহাসংকটে। অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া ঋণও ফেরত নিচ্ছে কয়েকটি ব্যাংক। এ অবস্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থা দেখছেন বিশ্লেষকরা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে চলছে চরম মূলধন সংকট। এ ঘাটতি মেটাতে এরই মধ্যে সরকারের কাছ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে ৬টি ব্যাংক। অপরদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে চলছে তারল্য সংকট। অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকই এখন ধারদেনা করে চলছে। এরই মধ্যে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে অর্ধশত কোটি টাকা ধার দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এমন অবস্থায় আমানত সংগ্রহে মরিয়া বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বেশি সুদের প্রস্তাব দিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছেন টাকাওয়ালাদের। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সুদের হার বেড়ে চলেছে। একইসঙ্গে ঋণগ্রহীতাদেরও গুনতে হচ্ছে বেশি সুদ। ব্যাংকগুলোর এমন শোচনীয় অবস্থা যে, বাড়তি সুদেও ব্যবসায়ীদের টাকা দিতে পারছে না অনেক ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর এ দৈনদশার কারণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে নেমে এসেছে হতাশার ছাপ।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, তারল্য সংকটের কারণে মাস দু-এক আগেও ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ৮-৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিত। যা এখন ২-৩ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে। একইভাবে বেড়ে গেছে ভোক্তা ও গৃহঋণের সুদের হারও।

বিশ্লেষকরা হঠাৎ করে ব্যাংকের এই টাকার সংকটের পেছনে কয়েকটি কারণ খুঁজে বের করেছেন, তার মধ্যে প্রধানতম কারণ হলো- ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের সীমা অতিক্রম করা।

সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়া এবং সুদ কম পাওয়ায় আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার কারণেও ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে পড়েছে। এছাড়া ডলার বিক্রি করে ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের অর্থ তুলে নেওয়া, ভুয়া কাগজপত্রে প্রভাবশালীদের ঋণ দেওয়া এবং সে টাকা বিদেশে পাচার হওয়া, ঋণ বিতরণের নামে অবৈধ পন্থায় ব্যাংক থেকে টাকা লুট ও মালিক পক্ষের নৈতিক স্খলন, আশঙ্কাজনকভাবে রেমিটেন্স কমে যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি ব্যাংকের টাকা লুটপাট, রিজার্ভ চুরি, বিশেষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে দেশের অনেকগুলো ব্যাংকের মালিকানা চলে যাওয়ার কারণেও ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকের সঙ্গে আমানতকারী, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করে একটা নতুন যাত্রা শুরু করেছে সেই সময়ে এ ধরনের অর্থনৈতিক সংকট আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন কোনো প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে কি না এ নিয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত।

এসব ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ, খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ  বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নশীলতার যাত্রা এবং চ্যালেঞ্জ সেটা ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা। এটার সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের সংকট টেনে আনা উচিত হবে না। দেশের টোটাল জিডিপিতে আর্থিক খাত ১০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। সেখানে ব্যাংক একটা ছোট্ট কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাত। এ ক্ষেত্রে যে সংকট চলছে তার প্রভাব সামগ্রিক উন্নয়ন বা উন্নয়নশীলতার যে চ্যালেঞ্জের কথা বলা হচ্ছে সেটাতে খুব বেশি পড়বে না। তবে এটা ঠিক, ব্যাংকিং খাতে যে একটা সংকট চলছে সেটা মানতে হবে।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট নেই। সংকট চলছে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে। ডিপোজিটের বেশি ঋণ দিয়ে ফেলার কারণে এ সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। এটা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে। তারা যদি বিষয়টিকে যথাসময়ে আমলে নিত তাহলে এ সংকট তৈরি হতো না।
পর পর কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট সামনে চলে আসায় আমানতকারী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্কের বিষয়টি মেনে নিয়ে তিনি বলেন- এটা ঠিক। তবে এ সংকট বেশিদিন থাকবে না। ব্যাংকিং সেক্টরে এ ধরনের সংকট স্বাভাবিক। দু-তিন মাসেই এটা কেটে যাবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হবে- পরিসংখ্যানের দিক থেকে তো কোনো অসুবিধা নেই। পরিসংখ্যানে যদি একটা দেশের সম্পদ বৃদ্ধি হয়, সম্পদ পাচার হয় তাতে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য তেমন একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। জিডিপি বাড়ানোর জন্য যত বেশি বাণিজ্যিকীকরণ হবে তত বেশি মার্কেটাইজেশন ঘটবে। একটা দেশে দুর্নীতি বাড়লেও জিডিপি বাড়ে।

কিন্তু যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো- একটা দেশের নিজস্ব ভিত্তির জন্য দরকার নিজস্ব অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। অথচ আমাদের অর্থনীতিতে অবারিত লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে সর্বত্রই অস্থিরতা চলছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সব টাকাই তো জনগণের টাকা। অথচ এসব টাকা কোথায় যাচ্ছে তা কেউ জানে না। জনগণ টাকা তুলতে গিয়ে টাকা পাচ্ছে না। এটা দেখার দরকার ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সে ধরনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই তো সুরক্ষিত নয়, তারা অন্য ব্যাংকগুলোকে কীভাবে সুরক্ষা দেবে? লুটপাটের অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে একটা দেশ কতটা সামনে যেতে পারবে?

তিনি বলেন, এখন জনগণের টাকা যেভাবে উধাও হয়ে যাচ্ছে, সেখানে জনগণের মধ্যে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। যে কোনো সময় এ ক্ষোভ একটা গণবিস্ফোরণেও পরিণত হতে পারে।

Recent Posts

Leave a Comment