‘ওরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকবে’

 In জাতীয়, প্রধান খবর

মাত্র দুদিন আগেই ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন নাজিম উদ্দিন (৩২)। স্ত্রী সাবরিনা ইয়াসমিন আইরিন এখনো হাসপাতালে ভর্তি। প্রতিদিনের মতো তিনি অপেক্ষায় ছিলেন কাজ শেষ করে নবজাতক সন্তান ও তাকে (আইরিন) দেখতে হাসপাতালে ছুটে আসবেন স্বামী নাজিম। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। দ্বিতীয় সন্তানের বাবা হওয়ার মাত্র তিন দিন পরই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী এই কর্মকর্তা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মোটরসাইকেলে করে তিনি শ্যামপুর থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুই বাসের প্রতিযোগিতার মাঝে পড়ে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নগরীতে বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার আরেক বলি হলেন তিনি। ঝরে গেল আরও একটি তাজা প্রাণ। তার এমন মৃত্যু স্বজন ও সহকর্মীরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এদিকে স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে নাজিমের স্ত্রী আইরিন বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তার একটাই প্রশ্ন, ‘ওরা (নাজিমের দুই সন্তান) এখন কাকে বাবা বলে ডাকবে।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাসেল মাহমুদ ও নাইম ইসলাম। তারও মোটরসাইকেলে করে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলেন। তারা যুগান্তরকে জানান, ঘটনাটি ঘটে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে মোটরসাইকেলে করে নাজিম যাচ্ছিলেন গুলিস্তানের দিকে। ফ্লাইওভারে উঠতেই তিনি পড়ে গেলেন দুটি বাসের প্রতিযোগিতার মাঝে। মঞ্জিল ও শ্রাবণ সুপার পরিবহনের দুটি বাস মরিয়া হয়ে প্রতিযোগিতা করছিল কে কার আগে যাবে। গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে শ্রাবণ সুপার পরিবহনের বাসটি নাজিমের মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। তিনি ছিটকে ফ্লাইওভারের সড়কে পড়ে গুরুতর আহত হন। দুই প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, নাজিমকে তারা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ১০টা ১০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় শ্রাবণ সুপার পরিবহনের বাস ও বাসচালক ওয়াহিদুলকে আটক করা হয়েছে। মঞ্জিল পরিবহনের চালকের সহকারী কামালকে আটক করা গেলেও বাসচালক পালিয়ে গেছে।

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আজিজুর রহমান যুগান্তরকে জানান, এ ঘটনায় বাসের শ্রাবণ সুপার পরিবহনের চালক ওয়াহিদুল এবং মঞ্জিল পরিবহনের চালকের সহকারী কামালকে থানায় রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

 

প্রত্যক্ষদর্শী নাইম ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমাদের মোটরসাইকেলটি প্রতিযোগী বাস দুটির পেছনে ছিল। আর নাজিম ছিল প্রতিযোগী বাস দুটির সামনে। নাজিমের মোটরসাইকেলটিকে শ্রাবণ সুপার পরিবহনের বাসটি ধাক্কা দিলে তিনি ছিটকে পড়ে যান। তিনি গুলিস্তানের আহাদ বক্সে এসে পুলিশকে বিষয়টি জানান। পরে পুলিশ শ্রাবণ পরিবহনের চালক ওয়াহিদুলকে আটক করে পুলিশ। আটক হওয়ার পরও ওয়াহিদুল স্বাভাবিক ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলেন। বলা যায় তিনি তখন অনেকটা নির্লিপ্ত ছিলেন, যেন কিছুই হয়নি। তার মোটরসাইকেলের সহযাত্রী রাসেল মাহমুদ সিএনজিতে করে নাজিমকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

নাজিমের ভাগনে শাহীন হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, তিন দিন আগে ঢাকার মগবাজারে আদ দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাজিমের স্ত্রী আইরিন একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। অস্ত্রোপচার করায় তিনি এখনো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নাজিমের বড় মেয়ে নুসরাত জাহান মুনের বয়স ৮ বছর। সে শ্যামপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। নাজিম ও স্ত্রীকে নিয়ে শ্যামপুরের ফরিদাবাদে থাকতেন। তার বাবার নাম আনিসুল হক। ভোলার লালমোহন উপজেলার বালুচর গ্রামে তাদের গ্রামের বাড়ি। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। নাজিম ঢাকাস্থ লালমোহন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক।

তিনি আরও জানান, ৯টা ২০ মিনিটে তার (শাহীন) সঙ্গে নাজিমের কথা হয়েছিল। নাজিম তাকে বলেছিলেন, কাকরাইলের একটি দোকানে গ্রামের মসজিদের জন্য ১৫ হাজার টাকায় একটি ঘড়ি তৈরি করতে দিয়েছেন তিনি। ভাগনেকে ওই ঘড়িটি সংগ্রহ করে গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর কথাও বলেছিলেন।

নাজিমের পারিবারিক সূত্র জানায়, নাজিমের মৃত্যুর পর আদ-দ্বীন হাসপাতাল থেকে তার স্ত্রী সাবরিনা ইয়াসমিন আইরিনকে শ্যামপুরের ফরিদাবাদের ২২৭/৩ নম্বর বাসায় নিয়ে আসা হয়। মাত্র তিন দিন আগেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। দুপুরের পর তিনি বাসায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামীর কথা বলে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।

নাজিমের ভাগনে শাহীন হাওলাদার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানান, মামির (নাজিমের স্ত্রী আইরিন) অবস্থা ভালো না। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে যেতে চাইছেন না তিনি। রাতে তাকে আবারো হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।

এদিকে নাজিমের এমন অকালমৃত্যু স্বজন ও সহকর্মীরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তার মৃত্যুর খবর শুনে সকাল থেকেই তারা হাসপাতালে ভিড় করতে থাকে। তার অনেক স্বজন ও সহকর্মী এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নাজিমের সহকর্মী রাব্বী রহমান যুগান্তরকে বলেন, ফুটফুটে দুটি শিশু সন্তানের বাবার এমন অকালমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। মাত্র দুদিন আগেই একটি কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন তিনি। বাস্তবতা হলো, ওরা (নাজিমের দুই সন্তান) ওদের বাবাকে হারালো। ওরা কখনোই আর বাবাকে ফিরে পাবে না। আর ভাবি (নাজিমের স্ত্রী আইরিন) কী অবস্থায় আছে জানি না। এটা তো তিনি মানতে পারবেন না।

নাজিম উদ্দিনের চাচাতো ভাই জামাল উদ্দিন বলেন, নাজিম এভাবে চলে যেতে পারে কখনোই ভাবিনি। ওর স্ত্রী আর দুই সন্তানকে কী সান্ত্বনা দেব ভাবতে পারছি না।

ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, নাজিমের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শ্যামপুরের ফরিদাবাদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে সন্ধ্যায় তার লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহনের উদ্দেশে রওনা হয়েছে পরিবার।

Recent Posts

Leave a Comment