মুক্তিযুদ্ধের বহু আগে থেকেই আপনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৬৬’তে ছয় দফা আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে আপনার বিরুদ্ধে মামলা হয়। হুলিয়াও জারি করা হয়। তখনকার আন্দোলন নিয়ে কিছু শুনতে চাই।
৫টি আর ৪টি, মোট ৯টি মামলা করা হয় আমার বিরুদ্ধে। ৫টা হচ্ছে ওয়ারেন্ট আর ৪টা জামিন অযোগ্য ওয়ারেন্ট। আন্দোলন শব্দের যেটা সত্যিকার অর্থ, আমরা তখন তাই করেছিলাম। এখন যেটা করা হয় সেটা টাকার জন্য। টাকা দিলে চিৎকার করে। টাকা না দিলে পোস্টারও লাগায় না। পোস্টার লাগাতে হলে যে টাকা দিতে হয়, সেটা আমরা জানতামই না। আমরা রাস্তায় পোস্টার লাগানোকে বলতাম ‘চিকা মারা’। এই চিকা মারতে হলে এখন রাতে রাস্তায় যেতে হবে, বাসায় ফিরতে হবে, গাড়িতে আসতে হবে, দুশ টাকা কনভেন্স দিতে হবে— এসব করা হয়। এটাকে তো আমরা আন্দোলন বলি না। আমরা এই আন্দোলন চিনিই না।
ঊনসত্তরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হল। আন্দোলনের মাধ্যমে যে ক’জন বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্ত করে এনেছিল আপনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
এটা তুমি বললে সে জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এখন তো কেউ আর সেই ঘটনা স্বীকার করে না। আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই স্বীকার করে না। স্বাধীনতা পদকই তো দেয়নি। তাহলে আমি সেটা বলব কী করে? ওটা ছিল আমার দিনের বেলা দেখা স্বপ্ন— যা আমি এখনো আমার বুকে লালন করি, অহঙ্কার করি। বঙ্গবন্ধুর জন্য, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্য যদি আমি মরেও যেতে পারতাম, সেখানে আমার একটুও দুঃখ থাকত না। কেউ এখন সেটা স্বীকার করুক আর না করুক, আই ডোন্ট কেয়ার।
২৫ মার্চ ১৯৭১ আপনার আবাসস্থল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসময়ের ইকবাল হল, এখন যার নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক। সে রাতে মিলিটারিরা সেখানে ভয়াবহ হামলা চালায়।
ভাগ্যক্রমে আমি রাত ৯টার সময় হল থেকে বেরিয়ে যাই। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। ওইসময় এটিএম জাফর আলম ছিলেন ইকবাল হলের ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট, তার বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের উখিয়ায়। ওইখানে পাকিস্তান আর্মি কোনোদিন যায়নি। ৭ মার্চ ভাষণের তিনদিন পর সে বাড়ি চলে যাবে বলে জানাল। আমি বললাম ‘তুই যাচ্ছিস কেন?’ জাফর বলল, ‘ভাই, আমার কেন যেন ভাল লাগছে না।’ হি ওয়াজ ভেরি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। পঁচিশে মার্চ রাতে আমি হল থেকে বের হচ্ছি। দেখি জাফর আলম সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমি তাকে দেখে বললাম ‘জাফর তুই?’ সে বলল, ‘সারাদেশ যখন যুদ্ধের জন্য উত্তাল হয়ে আছে পারভেজ ভাই, আমি আর থাকতে পারলাম না চলে আসছি। আপনি কোথায় যান?’ আমি বললাম, ‘দেখ, আমার তো এক ভাবি আছে। প্রতিদিন শুধু যন্ত্রণা করে আর বলে, সারাদিন নেতাগিরি কর আপত্তি নেই কিন্তু রাতের বেলায় বাসায় এসে ঘুমাতে পারো না? আজকে কেন জানি ভাল লাগছে না, যাই বাসায় গিয়ে ঘুমাই।’
ওই সময় হলে আমরা পনেরো-বিশ জন হলে থাকতাম। তাদের মধ্যে আমি বেরিয়ে যাই। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, সেই রাতে নিহত জাফরের কথা বলার জন্য। যার কথা কেউই বলে না, আমিই শুধু রেডিও-টেলিভিশনে গেলে তার কথা উচ্চারণ করি। তার ভাইয়েরা সেটা দেখে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হল— জাফরকে মারা হল তিন তলায়, তিন তলা থেকে পা ধরে টেনে নিচের দিকে নামানো হল। প্রত্যেকটা সিঁড়ির স্টেপে লেগে মাথাটা ফেটে গেল। স্বাধীনতার পরে যখন আমরা হলে গেলাম সেখানে রক্তের একটা স্ট্রাইপ ছিল। যেহেতু ওখানে মাথার ঘিলু রাবারের মতো জমে ছিল ঐ দাগটা তখনো মুছে যায়নি। রক্তের সেই স্ট্রাইপ দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছি আমরা। আমার মতো যারা ওখানে ছিল সবাই কেঁদেছে।
রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রযোজক হওয়ার ইচ্ছে হল কেন?
যুদ্ধের পর যখন ইকবাল হলে গেলাম সেখানকার দারোয়ান বলল, ‘ভাই আপনারা তো সবাই ফিরে এলেন, কিন্তু যারা চলে গেল, তারা তো আর ফিরে আসবে না।’ সেইদিন রিকশা দিয়ে বাসায় ফিরছি আর ওই কথাগুলো মনে গভীরে ক্ষতের সৃষ্টি করল। তখন মনে হল এমন কিছু কি করা যায় না যেখানে এই ঘটনাগুলো একসঙ্গে ফ্রেমবন্দি করা যায়? সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা। তৈরি হল ‘ওরা ১১ জন’। ৪৩ বছর চলচ্চিত্রে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছি, নিঃসন্দেহে সেটি ছিল চলচ্চিত্র হিসেবে অসাধারণ একটি কাজ।
১৯৭২ থেকে ২০১৬ ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণের ৪৪ বছরে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রের মান কতটা উন্নত হয়েছে?
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র তো এরপর আর হয়ই-নি।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে ‘গেরিলা’ তো বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
হ্যাঁ, ‘গেরিলা’কে মোটামুটি বলা যায়। তারপরও সেখানে হাজারটা ভুল আছে, কাটপিস লাগানো হয়েছে। সেখানে এফ-৮৬ প্লেন দেখানো হয়েছে। এফ-৮৬ প্লেন তারা কোথায় পেয়েছে? বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কাছে তো এই প্লেন নেই। ‘ওরা ১১ জন’-এ কোনো কাটপিস লাগানো হয়নি। সবকিছু ছিল রিয়েল। সেখানে রিয়েল ফায়ারিং দেখানো হয়েছে, পাকিস্তান আর্মি বম্বিং করছে সেটাও রিয়েল দেখানো হয়েছে।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আপনার যাতায়াত ছিল, বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ছিলেন আপনি, কোনো স্মৃতি কি তাড়িত করে?
স্মৃতি তো অনেক। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন কেবল আমি একা না, সবাই ছিলাম। ৩২ নাম্বার বাড়ির দুয়ার সবার জন্যই খোলা ছিল।
স্বাধীনতার পরপর ভাবি মানে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের একটা স্মৃতি আমাকে আজো তাড়িত করে। ১৮ ডিসেম্বর তাকে যখন বাড়িতে আনা হল, প্রচুর মানুষ সেখানে গিয়েছিল। ইন্ডিয়ান আর্মি, বড় বড় অফিসার থেকে শুরু করে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের ঢল সেখানে। আমি ভাবীর সঙ্গে দেখা করে চলে আসব, বিদায় নিতে গেলাম। উনি আমার হাতটা ধরে বললেন; ‘পরে যা, এখন যাইস না।’ উনি তো সেখানে খুব বেশি মানুষ চিনেন না। এত মানুষ সেখানে দেখে তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। পরে যখন ইকবাল হল থেকে আমাদের আরো ছেলেরা আসল, তিনি নিজেই বললেন, ‘এখন যা।’ এ স্মৃতি আমি কোনোদিন ভুলব না। কত জ্বালাতন যে আমরা তাকে করতাম। ৩২ নম্বর বাড়িতে গেলে আমরা একেকজন একেক খাবারের আবদার করতাম। উনি হাত দেখিয়ে বলতেন, ‘রাখ, রাখ দিতেছি, শান্ত হো তোরা।’ মা বলতে যা বুঝায়, প্রকৃতপক্ষে তিনি তাই ছিলেন।
তাকে নাকি এখন কেউ কেউ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বানিয়ে ফেলছে, মাই গড! রাজনীতির ধারে-কাছ দিয়েও তো তিনি যেতেন না। তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক পরামর্শ দিতেন! আমরা যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছি তারা জানি সংসার ছাড়া অন্য কিছু ভাবার কোনো অবকাশ তার ছিল না।
স্বাধীনতার ৪৪ বছরে চলচ্চিত্রের জন্য আমাদের সরকারগুলো কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
বিমাতাসুলভ আচরণ ছাড়া কিছুই করেনি।
তরুণ প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিয়ে আপনার আশাবাদ কী?
তরুণ নির্মাতাদের নিয়ে আমার কোনো আশাবাদ নেই। টেকনিক্যালি তারা আমাদের থেকে অনেক আপডেটেড, কিন্তু তারা ‘রোবট’ ছাড়া কিছুই না। টেকনিক্যাল দিক থেকে তারা হয়ত উন্নত কিন্তু ইমোশন কোথায়? আমাদের আগের যেকোনো ছবি দেখলে তোমার চোখে পানি আসবে, আবার তুমি আনন্দিতও হবে। ‘অ্যাভাটার’ দেখে তোমাদের কি কান্না আসে, তোমরা সেখান থেকে কি শিখতে পেরেছো?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পূর্ণ হচ্ছে, এতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার অনুভূতি কেমন? জাতি কী কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হচ্ছে?
সত্য কথা আমি বলতে পারবো ন, তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না।
মুক্তিযুদ্ধ যেন এখন একটা তুরুপের তাসে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাও সেরকম। মুক্তিযোদ্ধারা এখন সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই তারা নতুন সুর ধরেছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যারা বলছে, তাদের কেউ কেউ তো সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিত। অথচ এরাই আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার কেবিনেটের প্রভাবশালী মন্ত্রী! বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এরাই ট্র্যাঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে ড্যান্স করেছিল।
৪০ বছর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে কেন দল পরিবর্তন করলেন?
আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ আছে? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আছে সেখানে? এই প্রসঙ্গে আমার আর কিছু বলার নেই।