লালনের গানই মুখ্য, কে গৌণ

 In বিনোদন, বিশেষ প্রতিবেদন, সফল মানুষ

 

লালনের গানই মুখ্য, কে গৌণ

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য কলকাতার লোকগানের দল দোহার’র প্রতিষ্ঠাতা। তার ও তাদের যূথবদ্ধতায় দোহার বাংলা গানে গেঁড়েছে স্থায়ী এক নোঙ্গর, যা সবার কাছেই আরাধ্য। কীভাবে অর্জিত হল এই সাফল্য-সূচক? বলা-না বলা সেসব বিত্তান্তের খসড়া খতিয়ান বিছিয়েছেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন কাজল রশীদ শাহীন

দ্বিতীয় পর্বএখন ঢাকায় আসলে কেমন মনে হয়?
না চেনার একটা সুবিধা থাকে, নিজের মতো ঘোরা যায়। কিন্তু এখন যেখানেই দাঁড়াই দু-চারটা লোক চিনে ফেলে। এর জন্যে আবার ভালোলাগাও আছে। আমি যে কাজটি করি, তার জন্যে লোকে যদি আমাকে চেনে তাহলে ভালোলাগা কাজ করা স্বাভাবিক।

দোহার কি কখনো ভাঙনের মুখে পড়েছে?
শিল্পী বের হয়ে গেছে, আবার এসেছে—সেটাকে দোহার ভাঙা বলা যাবে না। দোহারের মূল হলো আমি আর রাজীব। আমাদের মধ্যে কোনো ভাঙন হলে, দোহার ভেঙে যাবে। তবে সেই সম্ভাবনা নেই এই কারণে যে, আমরা যেহেতু উত্তরপূর্ব ভারতের গান নিয়ে কাজ করি। এই অঞ্চলের মানুষ আমাদের তাদের প্রতিনিধি ভাবে।

আপনারা লালন এবং শাহ আবদুল করীমের গান করেছেন। এই দু’জনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দুজনের গানের অনেক পার্থক্য আছে। এটা বলতে হলে সঙ্গীতের তাত্ত্বিক বিষয়ের ভেতর যেতে হবে। বাউল গানের কোনো সুর হয় না। ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়ার একটা নিজস্ব ঢং আছে, বাউল গানের নিজস্ব সুরের কোনো ঢং নেই। রবীন্দ্রনাথের বাউল-আঙ্গিক গানের কথা অনেক পণ্ডিত বলেন, এটা কিন্তু ভুল বলা।

বাউল-আঙ্গের দর্শন হতে পারে, সুর হতে পারে না। বাউল গানের সুরের মিল থাকে না এই কারণে যে, বাউল যে সুরটাকে গ্রহণ করে সেটা হল তার অঞ্চলের সুর। শাহ আব্দুল করিম যখন দেহতত্ত্বের পদ গাইবেন, বা দুরবিন শাহ যখন দেহতত্ত্বের পদ রচনা করবেন, তাদের সুরে ভাটিয়ালি আসবে কিন্তু লালন শাহের সুর আসবে না। কারণ ঐ সুরটা নদীয়ার সুর।

‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’—এই গানগুলোর চলন হল নদীয়ার চলন। আবার আপনি ভারতবর্ষের বীরভূম অঞ্চলে গেলে দেখবেন, পূর্ণদাস বাউল, নবনী দাস বাউল (পূর্ণদাস বাউলের বাবা) এদের সুরের চলনটা আলাদা। এটা বীরভূমী চলন। এই যে সুরের আঞ্চলিকতা, এই জন্যেই বাউল পদকে লোকসঙ্গীত বলা হয়।

এখানে শাহ আব্দুল করিম একটু ব্যতিক্রম। তিনি নিজে কম্পোজার। আমার কাছে উনাকে একজন মিউজিশিয়ান হিসেবে মনে হয়, উনি আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকটি গানের সুর করতেন। আর লালনের গানগুলো উনি উনার ভক্তদের বসিয়ে একটা (একই) সুরে গাইতেন। লালন পার্টিকুলারলি আলাদা করে বসে সুর করছেন, এমনটি মনে হয় ঘটেনি। তিনি গান বলতে বলতেই সুর হয়ে যেত। সেটা তার অঞ্চলের সুর।

পরবর্তীকালে তার গান মডিফাইড হয়েছে। ফরিদা পারভীনের গলায় আমরা যে গান শুনি, এটা মডিফাইড। আবুল আহসান চৌধুরীর কাছে অনেক সংগ্রহ আছে, যেমন খোদা বক্সের গান, ফরিদা পারভীনের গুরু মকসেদ আলী সাঁইয়ের গান, এদের সঙ্গে আমাদের আজকের লালন শিল্পীদের গানের ভেতর অনেক ফারাক আছে। ওরা একটা নির্দিষ্ট ঢঙে গাইতেন। লালন সাঁই কিন্তু বড় সাধক, তার কাছে সুরকল্পটা বড় কথা নয়। সুর একটা তার অবলম্বন মাত্র, তিনি কথাটা বলতে চান।

শাহ আবদুল করীমের কাছে বিষয়টি ফিফটি ফিফটি কাজ করেছে। তার ঘরানাটা ভাটিয়ালি হলেও নানান সময়ে কাওয়ালি সুর লাগিয়ে দিয়েছেন। ‘গান গাই আমার মনরে বুঝাই’ এই গানটা আমরা যতবার শুনি, এটা ফট করে একটা সুরকার বা লোককবির কাছে এই সুরটা বসানো কঠিন আছে। এই সুরটা বসাতে গেলে একটা কম্পোজারশিপ লাগে। হাসন রাজা কিন্তু কম্পোজার না। তার গানে যে নানারকম সুর করা, তার অধিকাংশ কিন্তু বিদিত লাল দাসের করা সুর। হাসন রাজাকে আমার জেঠুরা দেখেছেন, ও একসুরে গান গেয়ে যেতেন। ভক্তদের নিয়ে একটা বজরা ভাড়া করে উঠে যেতেন, আর গান চলত।

শাহ আব্দুল করিম বাউল কিনা এটা নিয়ে তো বিতর্ক আছে?
শাহ আব্দুল করিম নিজেও সেটা বলেছেন, তবে ব্যঙ্গ করে। উনার সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে দু’বার। আপনাকে লোকে বাউল বলে একথা বললে উনি বলেছেন, মানুষে কয়, আমি তো কই না। কেউ পাগল কয়, কেউ বাউল কয়। আমি বলব, শাহ আব্দুল করিম বাউল ছিলেন।

বাউলদের তো একটা আলাদা জীবনযাপনের ব্যাপার থাকে, তাদের নিজস্ব কিছু রীতি-নীতি আছে, শাহ আবদুল করীমের তো সেটা ছিল না বা উনি পালন করতেন না।
এখানে একটা ব্যাপার আছে। এই জীবনযাপনের রীতি ঘরে ঘরে আলাদা হয়, অঞ্চলভেদে আলাদা হয়। কুষ্টিয়ায় আপনি বাউলের যে জীবনযাপন দেখেন বা যেভাবে তারা দীক্ষা নেন, সেটি সিলেটের বাউলের ক্ষেত্রে সেভাবে হয় না।

সিলেটের বাউলদের প্রকৃত বাউল বলা যায় কিনা?
সেটা আলাদা কথা। এই ‘প্রকৃত’ বিষয়টাকে কে সেট করবে? এটা বলা মানে তো, আমি বলতে চাচ্ছি এটা প্রকৃত আর এটা প্রকৃত না। এভাবে তো কেউ বিষয়টি সেট করেনি। আপনি যদি আবার শরীয়তী পন্থায় যান, সে তো পুরা মারফতি সাধনাকেই বাতিল করে দেবে। উনিশ শতকে বাউল ধ্বংস ফতোয়া তো লেখা হয়েছিল।

শাহ আবদুল করিম, দূরবীন শাহ, সিতালং শাহ, আরকুম শাহ, শাহ নূর এরা একভাবে ঈশ্বরকে পাচ্ছেন; আর সাঁইজি, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, এরা আরেকভাবে পাচ্ছেন। বীরভূমে নবনী ক্ষ্যাপা, সুধীর ক্ষ্যাপা—এরা আরেকভাবে পাচ্ছেন। এদের তো আসলে বলে গৌনধর্ম সম্প্রদায়। যে ধর্ম সম্প্রদায়গুলো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মতের সাথে সংঘাত করে বেঁচে আছে। এদের কিন্তু একটা সংঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

আর দেখুন, একটা জায়গায় তো ওরা একটা বৃহৎ মানুষের অংশ। এটার হয়ত কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই, কিন্তু প্রচলিত আছে যে, ঠাকুর বাড়ির জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কাঙাল হরিনাথের পক্ষ নিয়ে সাঁইজি লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। অর্থাৎ এর সত্যতা থাকুক আর নাই থাকুক, মানুষ তো নিরূপণ করছে যে, আমার সাঁইজি হলেন ‘এই’।

এভাবে কিন্তু তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। একই কথা শাহ আবদুল করীমের ক্ষেত্রেও খাটে। নইলে তার বৌ যখন মারা যায়, মৌলভীরা কেন বলছে যে, আমি তার দাফন করব না। উনি নিজেই খাটের তলায় দাফন করে দিচ্ছেন স্ত্রী সরলাকে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি নামাজ পড়েন, রোজা করেন? বললেন, না।

আমি বললাম, আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন? বললেন, হ্যাঁ। তাহলে নামাজ পড়েন না যে? একথা বললে তিনি বললেন, আল্লাহ এত ছোট নাকি যে তিনি আকাশ থেকে দূরবীন দিয়ে দেখছেন আমি নামাজ পড়ছি কিনা! আল্লাহ অনেক বড় ব্যাপার। আল্লাহ (স্রষ্টা) অফিসের বস না।

আপনাকে কোন শিল্পী বা ঘরানা বেশি আলোড়িত করে?
দেখুন, আলোড়িত তো সব শিল্পীই করে। এটার নানারকম বিষয় আছে। আজ আমি যখন লালনের গান করছি, তিনি কে কী রকম এসব আমার জানার দরকার নেই। আমি তাকে তার গানের ভেতর দিয়ে পাই। আমার কাছে, লালনের গানই মুখ্য, কে গৌণ। আর এটা তো সত্যি, লালনের গান ছাড়া প্রামাণ্য প্রায় কিছু নেই। যা ভাবা হয়, তার সবটাই কল্পনা। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, যে মানুষটা অক্ষর জানেন না, তিনি লিখছেন, ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’। শব্দটা পাচ্ছেন কোথা থেকে? সেই মানুষটা যে টেক্সট বানাচ্ছেন, এ তো তার শাস্ত্রের উপর শাস্ত্র পড়া। বৈষ্ণব শাস্ত্র থেকে কুরআন থেকে তুলে তুলে উদ্ধৃত করছেন। এগুলো বাদ দিন, এই যে আরশীনগর একটা শব্দ, এই শব্দটাই তো উনার জন্ম দেওয়া।

আপনার সাথে অনেক কথা হল, জানা হল। পরিবর্তন ডটকমের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
দোহারের পক্ষ থেকে আপনাকে ও সকল বাংলা ভাষাভাষি মানুষকে আমাদের শ্রদ্ধা-স্নেহ ও ভালবাসা জানাচ্ছি।

Recent Posts

Leave a Comment