নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে জামায়াতে বিভাজন!
বিশেষ সংবাদদাতাঃ
যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে এমনিতেই কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামী। তার ওপর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব ও ইমেজ সংকট নিয়ে দলটির নেতারা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম চালাতে পারছে না জামায়াত। ফলে নির্বাচন ঘিরে দলটি ‘বিকল্প’ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে থাকতে চাইছে। অবশ্য কোনো বিষয়েই দলটির নেতারা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতীক যাই হোক না কেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তারা ভোটের মাঠে থাকতে চায়। ইতোমধ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু করেছে দলটি।
নির্বাচন প্রস্তুতি নিলেও মূলত জামায়াতের মধ্যে ‘যুদ্ধাপরাধের তকমা’ ঝেড়ে ফেলতে নবীন ও প্রবীণদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
দলটির নবীন নেতৃত্ব মনে করেন, নতুন করে নিবন্ধন নিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া উচিত।
বিপরীতে প্রবীণরা জামায়াতকে নিয়ে সরকারের অবস্থানের ‘চূড়ান্ত’ ফায়সালার পরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ এবং দলটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেন। পরে তাদের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ বাদ দেয় নির্বাচন কমিশন।
ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাদের বিচার শুরু করে।
চলতি বছর পর্যন্ত জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় ৫ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়া কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গতবছরের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের পর থেকে দলটি নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একই বছর সেক্রেটারি জেনারেলসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের (নীতি নির্ধারণী ফোরাম) এক বৈঠকে বর্তমান আমির মকবুল আহমাদকে এ নিয়ে তোপের মুখেও পড়তে হয়। যদিও পরে ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর মকবুল আহমাদ আমির হিসেবে শপথ নেন।
এরপর নায়েবে আমির হিসেবে নিয়োগ পান- অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, মিয়া মোহাম্মদ গোলাম পরওয়ার, মাওলানা শামসুল ইসলাম ও আতাউর রহমান।
এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে ডা. শফিকুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে এটিএম মাছুম, রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদ নিয়োগ পান।
অভিযোগ আছে, মকবুল আহমাদ জামায়াতে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের পর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিজের অনুসারি এটিএম মাছুমকে নিয়োগ দেন।
কোনো কারণে ডা. শফিক কারাগারে গেলে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে তারই কোনো অনুসারি যাতে থাকেন, সেজন্যই এ কৌশল নেন তিনি।
এটিএম মাছুম জামায়াতের আমিরসহ সব নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।
দলীয় গঠনতন্ত্র না মেনে উল্লিখিত পদগুলোয় নিয়োগ দিয়েছেন জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদ। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের পরামর্শ নেওয়ার কথা থাকলেও তা তিনি অনুসরণ করেননি। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে দলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানা গেছে, সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে কার্যনির্বাহী পরিষদের ১৯ সদস্যের মধ্যে ১৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এরমধ্যে অধ্যাপক তাসনীম আলম, আবদুল হালিম, নজরুল ইসলাম বুলবুল, ডা. আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, সেলিম উদ্দিনসহ কয়েকজনের নাম জানা গেছে।
এছাড়া এক বছরেও গত কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, যুদ্ধাপরাধের দণ্ড পাওয়া সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া এটিএম আজহারুল ইসলামসহ আরও অনেকের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দলটি।
এদিকে এক সময় সংগঠনের কেউ গ্রেপ্তার হলে প্রতিবাদে রাজপথে কর্মসূচি পালন করতের জামায়াতের নেতাকর্মীরা। কিন্ত বিগত এক বছর কোনো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামেনি দলটি। শুধুমাত্র গণমাধ্যমে বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তাদের কর্মসূচি।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও রংপুর মহানগরী শাখার আমির অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলালকে গ্রেপ্তারের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে সংগঠননি।
দলের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানান।
তিনি বলেন, ‘সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বশূন্য করার যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে, তার অংশ হিসেবেই সারাদেশে নেতাকর্মীদের বেছে বেছে অব্যাহতভাবে গ্রেপ্তার করছে।’
ঈদুল আজহার আগেই মাহবুবুর রহমান বেলালসহ সারাদেশে গ্রেপ্তার জামায়াতের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানান মুজিবুর রহমান।
জানা গেছে, মূলত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই দলটি কোনো কর্মসূচি দিতে পারছে না। আবার বিবৃতির মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও কাউতে মাঠে নামাতে পারছেন না শীর্ষনেতৃত্ব