বিকল্প রাজনীতির উচ্চকণ্ঠ নাকি দিশাহীনতা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
রাজনীতি নিয়ে অনেক ধরণের হাস্যরস আছে পশ্চিমা জগতে। আমাদের দেশে সহিষ্ণুতা কম বিধায় সাধারণত রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না মানুষজন। নির্বাচন আসছে। এই ভোট সম্পর্কেও কত কথা আছে। বলা হয়, ‘ভোট হলো সন্ত্রাসী, খুনি ও সমাজবিরোধীদের ক্ষমতায়ন করতে সাধারণ মানুষের আসাধারণ ক্ষমতা।’
এর মধ্যেই গত ১৩ জুলাই এবং ২ আগষ্ট জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির প্রধান নেতা আ স ম আব্দুর রব ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নারা দুই দফা বসেছেন নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করার বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে। নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের এই উদ্যোগকে চড়া গলায় সমর্থন করেছে বিএনপি। কিছুটা ভদ্রতার ভেতর স্বাগত জানিয়েছে আওয়ামী লীগও।
ভ্রাম্যমাণ রাজনীতিকরা একত্রিত হচ্ছেন, বলছেন দুই প্রধান দলের বাইরে নতুন ধরণের রাজনীতি উপহার দিতে চান তারা। প্রথম বৈঠকটি যেনতেনভাবে হলে দ্বিতীয় বৈঠকটি বেশ সময় নিয়েই হয়েছে। কিন্তু তাদের কথায় হোঁচট খেতে হলো প্রথমেই। তারা প্রচলিত ধারার বাইরে যে রাজনীতি চায়, সেখানে পতিত স্বৈরাচার এরশাদের ভাই জি এম কাদেরের উপস্থিতি কি সত্যিই জানান দেয় যে আসলই নতুন কিছু আসছে রাজনীতিতে?
ডান, বাম, মাঝামাঝি যে যে দিকেই দাঁড়িয়ে থাকুক, পরিবর্তনের বাস্তবতাকে অবহেলা করা শক্ত। যারা এই পরিবর্তনকে ধারণ করার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তারা আসলে কারা? তারা কি পারবে একটা সত্যিকারের নাড়া দিতে?
তীব্র সংঘাতময়, দ্রুত ধাবমান বর্তমানের রাজনীতির বাইরে যেতে চাইলে যে প্রয়োজনীয় ও নিরাপদ দূরত্ব লাগে, তার সুযোগ এখানে নেই। কারণ এরা প্রত্যেকেই নির্মোহভাবে প্রচলিত রাজনীতির বিকল্প হিসেবে ভাবছেন না। এদের ভাবনায় কেবল শাসক দলের উচ্ছেদ। ২০০৮-এ এক ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা, তার আগে দুই বছরের আধা সামরিক শাসন এবং তারও আগে চার দলীয় জোটের শাসন, সেখানে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রীত্ব এবং পরবর্তিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার, উভয় শাসনামলেই দুর্নীতির স্বরূপ নিয়ে তাদের অবস্থান এখনো ধোঁয়াশে।
তাই তাদের উদ্যোগে আশু রাজনৈতিক লাভ হতে পারে যে কিছু মিডিয়া কভারেজ তারা পাবেন, রাজনৈতিক লাভ এখনো নিশ্চিত নয়। নতুন উদ্যোগে যেমন আছে সাবেক বিএনপি নেতা বি চৌধুরী ও জি এম কাদেরের মতো চরম ডানপন্থী, তেমনি সামনের সারিতে আছেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আ স ম রবের মতো সাবেক বাম পন্থী। মান্না এবং রব, এখন যতটা না রাজনীতিক, তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিজীবী। বিশেষ করে বলতে হয়, এরা বাম গৃহস্থীতে বেড়ে উঠা বুদ্ধিজীবী।
এহেন বুদ্ধিজীবীদের একটা উদ্যোগ তাহলে কেমন হবে, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। সময়ই বলে দেবে। তবে অতীততো বর্তমান শুধু নয়, ভবিষ্যৎকেও নির্দেশনা দেয়। তারা অতীতে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি করেছেন, কিন্তু কখনোই সেই রাজনীতি বৃহদর্থে সমাজের নীচের ধাপের, ক্ষমতাহীন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর পক্ষে ছিল না।
বাম রাজনীতি মানে হলো বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোটাকে এমন ভাবে বদলানো, যাতে সামাজিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনাগুলো দূর করা যায় এবং বঞ্চিতরা নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু এরা কখনোই সে রাজনীতি করেনি, করেছে প্রচলিত বুর্জোয়া রাজনীতির ‘অ-রাজনীতি’।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে এমনসব বাম রাজনীতি দেখা গিয়েছিল যা পৃথিবীতে বিরল, যার মধ্যে ছিল বিচিত্র ধারণা ও বস্তুর সমাহার! কত যে পথ, মত আর আদর্শ, তার সংখ্যা এখনো ক্যালকুলেটরে গণনা করতে হয়। বিরোধী নিধন, দুর্বৃত্ত পোষণ, ধর্ষণ; দরিদ্র-নিপীড়িতদের ক্ষমতায়নের বিপরীতে সমাজের প্রাচীন উচ্চবর্গীয় কাঠামোটাকে মজবুত করার মতো কুকর্মের শৃঙ্খলা ছাড়া এদের রাজনীতিতে আর কোন প্রণোদনা ছিল না।
মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক পুষ্টিহীনতায় শীর্ণ যারা তারা আজ নতুন কৌশল করছে বন্ধুবৃত্তটা বাড়াতে। কিন্তু রাজনীতির সংকীর্ণ রূপটার কারিগর যারা তারা কি পারে বৃহত্তর প্রেক্ষাপট রচনা করতে? আজ দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির জ্বালায় অস্থির সবাই। একটা সময় এরাও ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বরগুলোর লাঞ্ছনা ও অপমান দেখেছিলেন, কিন্তু এদের রাজনীতি ছিল প্রশ্নহীন আনুগত্য। তাই এরা এদল, ওদল করেছেন ঠিকই, কিন্তু আদর্শ ছিল স্বৈরাচারের গৃহপালিত বিরোধি দলের নেতা হওয়া।
আজকের বাংলাদেশে দরিদ্র, অবদমিত, ক্ষমতাবৃত্তের বহু দূরে থাকা নিষ্পেষিত জনতার পক্ষে কোন কণ্ঠস্বর এরা নন। নতুন ধরণের রাজনীতি নিয়ে সমস্যা ততটা নয়, যতটা সমস্যা উদ্যোক্তাদের রূপ রস আর রঙ্গ নিয়ে। মেকি বাম আর আসল ডানের মোড়কটা কেমন হবে তা বোঝা যায়। মানুষের প্রতি, চিন্তার প্রতি, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার প্রমাণ এরা কখনো দিতে পারেননি।
সমষ্টির বিকাশ নয়, সমষ্টির অস্তিত্ব ও চিন্তাকে পকেটে রেখে সময় মতো ব্যবহার করার পুঁজিবাদী দক্ষতা অর্জনে পারদর্শীরা বড়জোর কিছু ভাবনার প্রসার ঘটাতে পারবেন, ইতিহাস হতে পারবেন না। অপেক্ষায় আছি বিকল্প রাজনীতির উচ্চকণ্ঠ নাকি দিশাহীনতা দেখতে হয় শেষ পর্যন্ত।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।