মাটিতে লাশ পুঁতে ওপরে রান্নার চুলা
মির্জা মেহেদী তমাল
মফস্বল শহরের কাছে ছোট্ট একটি গ্রাম। শীতের শুরুর এক রাতে পুরো গ্রাম ঘুমে।
শুধু একটি বাড়ির পরিবেশ ভিন্ন। বেডরুমের খাটের ওপর পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। পাশে রক্তমাখা বঁটি হাতে বসা তার স্ত্রী। হাত, মুখ ও শরীরেও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। ফুঁসছেন তিনি। বিড়বিড় করছেন। পুরো বাড়িতে আর কেউ নেই। একপর্যায়ে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। লাশ নিয়ে কী করবেন! এমন চিন্তায় ছোটাছুটি শুরু হলো তার। ঘর, উঠান আর রান্নাঘর করছেন। লাশ তো সরাতে হবে। একসময় কী ভেবে পাশের বাড়িতে গিয়ে পরিচিত এক লোকের সাহায্য চাইলেন। তার পরামর্শ, আঁধার থাকতেই লাশ পাশের খালে ফেলতে হবে। কিন্তু পরামর্শটি তার পছন্দ হলো না। যা করার তিনি একাই করবেন। খাট থেকে স্বামীর লাশটি টানতে টানতে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। এক কোণে তিনি একাই কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়লেন। কাপড় আর কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে লাশটি সেই গর্তে ফেলে মাটিচাপা দিলেন। কিন্তু এতেও সন্দেহ থেকে যেতে পারে। সে কারণে লাশের ওপরই তৈরি করে ফেললেন একটি মাটির চুলা। আগুন ধরালেন। পাতিল বসিয়ে রান্নার সুব্যবস্থা হলো। রান্নাঘর নতুন করে লেপে দিলেন। নিজেও গোসল করে পরিষ্কার। ততক্ষণে চারদিক ফরসা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মাটিচাপা দিয়ে সত্য গোপন রাখা যায়নি। ১০ দিন পর বেরিয়ে আসে সব। রান্নাঘর থেকে দুর্গন্ধের উেসর সন্ধান করতে গিয়ে মাটি খুঁড়লে বেরিয়ে আসে লাশ। ঘটনাটি চট্টগ্রামের রাউজানের। ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর চুলার নিচ থেকে পুলিশ দুদু মিয়া (৩৩) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। গ্রেফতার করা হয় তার স্ত্রী শাহনাজ বেগমকে। জেরার মুখে শাহনাজ পুলিশকে জানান রোমহর্ষক সেই স্বামী হত্যার আদ্যোপান্ত। বলেছেন, ঈদুল আজহার রাতে স্বামীকে হত্যা করে রান্নাঘরেই গর্ত করে লাশ পুঁতে রাখেন তিনি। স্বামী পরনারীতে আসক্ত, এমন সন্দেহের একপর্যায়ে এই খুনের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানিয়েছে। শাহনাজ বেগম এখন কারাগারে। এ ঘটনায় আরও এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। যিনি শাহনাজকে লাশ গুমের পরামর্শ দিয়েছিলেন। দুদু মিয়া পেশায় একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক। ঘাতক শাহনাজের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৭ বছর আগে। তাদের সংসারে দুই ছেলেমেয়ে। শাহনাজের বাবার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা এলাকায়। তার বাবার নাম আবুল খায়ের।
যেভাবে খুন ও গুম : ‘ঈদের রাতে দুদু মিয়া বাইরে থেকে বাসায় ফিরে আসেন। এরপর তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটি শুরু হয় প্রথমে আর্থিক অনটন নিয়ে। পরে পরকীয়ার বিষয়ে তা গড়ায়। এতে হাতাহাতি হয়। দুদু মিয়া উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি শাহনাজকে ধাক্কা দেন। শাহনাজ খাটে পড়ে যান। রাত সাড়ে ১০টায় আবারও ঝগড়া হয় টাকা-পয়সা নিয়ে। একপর্যায়ে দুদু মিয়া তাকে রেগে কথা বলেন। বলেন, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকে কেটে খালে ভাসিয়ে দেব। ’ এই কথা বলে তিনি এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়েন। পুলিশের কাছে শাহনাজ পুরো ঘটনার বর্ণনা করেন। তিনি পুলিশকে বলেছেন, ‘রাতে আমি বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে থাকি। এরপর রাত ১টায় তাকে খুন করার পরিকল্পনা করি। ঝগড়া করার সময় সে আমাকে বলে, আমি নাকি কার সঙ্গে গিয়ে গিয়ে কথা বলি। তার অগোচরে অন্য লোকের বাড়িতে যাই। তাই সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে চাইছি। প্রতিদিন এই কারণে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করি। এসব কথা বার বার আমার কানে বাজছিল। নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আশপাশের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন রান্নাঘরে যাই। বেশ কয়েকবার বঁটিটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখি। একবার হাত কাঁপছিল। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। রাত ২টায় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিই। এরপর তার হাত-পা বেঁধে ফেলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকের ওপর প্রথম কোপ দিই। এই সময় ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। আমার চোখেমুখে, হাতে রক্ত লাগে। তারপর গলায় দ্বিতীয় আঘাত করতেই দেখি সে গোঙাচ্ছে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বার বার কোপাতে থাকি। ততক্ষণে রক্তে ভেসে গেছে পুরো ঘর। আমি দ্রুত বিছানার চাদর ও খাটের কাপড় বদলে ফেলার কথা ভাবী। কিন্তু এই সময় টেনশনে পড়ে যাই কীভাবে লাশ সরাব। বাড়ির পাশের বাবুল ভাইয়ের সহায়তা চাই। তিনি আমাকে বলেন, “লাশ সবার ঘুম ভাঙার আগেই স্থানীয় সর্তা খালে ফেলে দাও। ” আমি টেনেহিঁচড়ে লাশ নিতে গিয়ে বিপদের কথা চিন্তা করি। এরপর বাড়িতেই লাশ পোঁতার পথ খুঁজতে থাকি। শেষমেশ বুদ্ধি আসে যেখানে রান্না করি সেই চুলার নিচেই তার লাশ চাপা দেওয়ার। তখন একাই কোদাল ও শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকি। প্লাস্টিকের কাগজ ও কাপড় মুড়িয়ে সেখানে শুইয়ে দিয়ে তাকে মাটিচাপা দিই। তারপর দ্রুত পানি দিয়ে আশপাশের জায়গায় মাটি লেপে দিই। এভাবে এক দিন, দুই দিন পর তার খোঁজে গ্রামের লোকজন বাড়িতে আসতে থাকে। জিজ্ঞাসা করে সে কোথায়। আমি বলি গাড়ি নিয়ে শহরে গেছে। এভাবে ১০ দিন অতিবাহিত করি। বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে ঘটনা ধামাচাপা দেব। প্রতি রাতে ঘুম আসত না। লাশ পুঁতে রাখার বেশ কিছু দিন পর সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। এ নিয়েও আমি ভীষণ চিন্তায়। আশপাশের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করলেও আমি বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গেছি। এর মধ্যে তার কোনো খোঁজ না পেয়ে প্রতিবেশীরা বাড়িতে আসতে থাকে। হঠাৎ একদিন পুলিশ হাজির। সঙ্গে প্রতিবেশী কয়েকজন। বুঝলাম, তারা সন্দেহ করে পুলিশকে জানিয়েছে। ’ রাউজান থানা পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে লাশ পুঁতে রাখার কথা স্বীকার করেন শাহনাজ। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাটি থেকে দুদু মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পরপরই পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন বাবুল নামের সেই ব্যক্তিও।