৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াল খেলাপি ঋণ
বিশেষ প্রতিবেদকঃ
বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়ার কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমার কথা। কিন্তু ফল উল্টো হচ্ছে। সুবিধা নেওয়ার কিছুদিন পর পুনঃতফসিল করা অনেক ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর তিন মাস আগের তুলনায় বেড়েছে ৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮২ শতাংশ বা ৬৫ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা মন্দমানে শ্রেণিকৃত। এ মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৩ সালে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো ছিল না। তখন খেলাপি ঋণ হু-হু করে বাড়তে থাকায় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের দাবির মুখে প্রথমে শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ সুযোগ নিয়ে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। সেই ঋণের একটি বড় অংশ এখন খেলাপি। এর পর ব্যাংক খাতে পাঁচশ’ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে- এরকম ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপকে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। তবে পুনর্গঠনের শর্ত মেনে যথাসময়ে ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ায় এসব ঋণের একটি অংশ ফের খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ঋণ পুনর্গঠনের শর্ত শিথিলের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, গত ৭-৮ বছর ধরে ঋণের নামে খারাপ লোকদের যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, পুনঃতফসিল কিংবা পুনর্গঠনের মাধ্যমে বারবার তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে এখন আর নতুন করে সুবিধা দিতে না পারায় খেলাপি ঋণ অনবরত বাড়ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর পরিচালক রাখার যে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তা কার্যকর হলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও পরিস্থিতি খুব খারাপ অবস্থায় যাবে বলে মনে করেন তিনি। সেই ব্যাংক কোম্পানি আইন আজ সংসদে পাস হওয়ার কথা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এখন নতুন সুবিধার বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদের বিবেচনাধীন রয়েছে। পর্ষদ থেকে অনুমোদিত হলেই কেবল তারা সুবিধা পাবেন। খেলাপি ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, সাধারণভাবে বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এসে খেলাপি ঋণ একটু বাড়ে। তবে আদায় জোরদার, পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন কারণে ডিসেম্বর প্রান্তিকে আবার কমতে দেখা যায়। এবারও সেরকম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে যথাসময়ে আদায় না হওয়া ঋণকে ব্যাংকগুলো নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ মানে শ্রেণিকরণ করে। আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে ব্যাংকগুলোকে এসব ঋণের বিপরীতে ২০, ৫০ ও ১০০ ভাগ হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয়। মন্দমানে শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় খুব কম হয় বিধায় এ ধরনের ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৬৫ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা মন্দমানে শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ে। সন্দেহজনক মানে রয়েছে ৪ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। আর ৯ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা নিম্নমানে শ্রেণিকৃত হয়ে পড়েছে। এদিকে সব ব্যাংক যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেনি বলে ৬ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ এখন খেলাপি। তিন মাস আগে জুন শেষে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ছিল, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর আগে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা, যা ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট খেলাপি ঋণের পরিমাণের পাশাপাশি হারও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এসব ঋণের মধ্যে ৩১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা মন্দমানে শ্রেণিকৃত। রাষ্ট্রীয় মালিকানার এই ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এর মূলে রয়েছে জনতা ব্যাংক। গত জুনে যেখানে ব্যাংকটির ৫ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা খেলাপি ছিল, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ৮ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ মোটামুটি আগের প্রান্তিকের মতোই রয়েছে। সরকারি মালিকানার দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আগের মতোই ৫ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা রয়েছে, যা তাদের মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে তিন মাসে খেলাপি ঋণ ২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা বেড়ে মোট ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা হয়েছে। এ খাতে খেলাপি ঋণের হার ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে মন্দমানে শ্রেণিকৃত ২৭ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ২৪ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা ছিল। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে ৩৭৮ কোটি টাকায় উঠেছে। ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ সামান্য কমে ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকায় নেমেছে। এর মধ্যে মন্দমানে শ্রেণিকৃত রয়েছে ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা।