হরিপদর বাড়িতে ছোট দুটি ঘর, একটিতে তারা বসবাস করেন, অন্যটিতে তেল তৈরির জন্য ঘানি বসানো হয়েছে। ঘানিতে সরিষা দিয়ে স্বামী স্ত্রী পালাক্রমে আবার কখনও একসাথে টেনে চলছেন ঘানি।
ঘানি টানতে টানতে হরিপদ সাহা বলেন, ‘৫ কেজি সরিষা দেওয়া আছে, এই থেকে যে তেল হবে তা গ্রামের হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যাব। তেল বিক্রি হলেই তার লাভের অংশ দিয়ে দুপুরের খাওয়ার জন্য চাল কিনতে পারব। তারপর খেতে পাব।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছি। মাঝে একবার একটা গরু কিনেছিলাম। কিন্তু দুটো মেয়ের বিয়েতে সে গরু বিক্রি করে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ করেছি। তারপর থেকে আর গরু কেনার টাকা জোগাড় করতে পারিনি, এখন দুই হাজার টাকা পুঁজি আছে, তা দিয়ে সরিষা কিনে কোনোরকমে তেল করি।’
প্রতিদিন কত আয় হয় জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ কেজি তেল বিক্রি হয়। তাতে লাভ ৬৫টাকা এবং খৈল থেকে পায় ১০০ টাকার মতো। সবমিলিয়ে দৈনিক ১৬৫ টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে তিন জনের সংসার কোনোরকমে চলে। কোনো কারণে তেল বিক্রি করতে না পারলে সেদিন না খেয়েই থাকতে হয়। দিনে ২বার সরিষা ভাঙাতে হয়। উন্নতমানের ১০ কেজি সরিষা থেকে তিন থেকে সাড়ে ৩ লিটার তেল হয়।’
হরিপদ কথায় কথায় বললেন, ‘ছোট মেয়েটি পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। এপর্যন্ত কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো কার্ড পাইনি। কোনো জমিজমা নেই। কয়েক শতক পৈত্রিক ভিটায় আট ভাই ঠেষাঠেষি করে কোনো রকমে থাকি।’
এখানেই শেষ হতে পারত এই কষ্টের কথাগুলো। তবে না, হরিপদর ছোট ভাই শম্ভুপদ সাহা (৬০) ও তার স্ত্রী শ্রী গাজলী রানী সাহা (৫৫) একই ভাবে ঘানি টানছেন। ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত তারা।
শম্ভুপদ বলেন, ‘আমাদের কোনো পুঁজি নেই। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাকিতে সরিষা কিনে এনে নিজে ঘানি টেনে সরিষা ভাঙিয়ে তেল ও খৈল বিক্রি করে পাওনাদারকে টাকা শোধ করার পর যা থাকে তাই দিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। টাকার অভাবে একটি গরু কিনতে পারছি না। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এভাবে নিজেরাই ঘানি টেনে সরিষা ভাঙাই।’
তিনি জানান, বন্যা, ভারী বর্ষণ বা অন্যকোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে গ্রামে যেতে না পারলে সেদিন না খেয়েই বাড়িতে বসে থাকতে হয়। এটাই আমাদের জীবন কাহিনী।
হরিপদর আরেকভাই শ্রী তারাপদ সাহা(৫৮), তারও আছে শুধু ঘানি ও ৪ হাজার টাকা পুঁজি। তাই দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সরিষা কিনে স্বামী–স্ত্রী পালাক্রমে ঘানি টেনে সরিষা ভাঙিয়ে দিনে প্রায় ৪ লিটার তেল ও সাড়ে ৫ কেজি খৈল বিক্রি করে লাভের অংশ দিয়ে কোনো রকমে দিন কাটান।
তারাপদ সাহা বলেন, আমরা তিনভাই এভাবেই দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে সংসার চালিয়ে আসছি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার ইচ্ছা থাকলেও অভাবের কারণে পারছি না।
পরিবার নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করলেও অন্যের দিকে চেয়ে না থেকে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করেই বেঁচে থাকতে চান হরিপদ সাহা, শম্ভুপদ সাহা ও তারাপদ সাহা।