আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে বিএনপির হার

 In জাতীয়

নানা শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন। যদিও দলীয় প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের হিসাব মেলাতে পারছে না বিএনপি। লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হওয়ার প্রত্যাশা করলেও ফল প্রকাশের পর তার উল্টো চিত্র দেখে নেতাকর্মীদের মাঝে অনেকটা হতাশা নেমে এসেছে। বাহ্যিকভাবে এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে স্বীকৃতি দিলেও এতে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ করা হয়েছে দলের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও জোর দাবি করেছে বিএনপি। তবে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে দলের পরাজয় হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির অনেক নেতা। পরাজয়ের পেছনে প্রার্থী নির্বাচনে দূরদর্শিতার অভাবসহ নানা ব্যর্থতাকেও দায়ী বলে মনে করছেন বিএনপি জোট নেতাদের অনেকে।
দলীয় সূত্রমতে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাসিক নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল বিএনপি। শেষ টেস্ট কেস হিসেবে আখ্যায়িত এ নির্বাচনে বিএনপি জোটের পক্ষ থেকে সাত খুনের মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে আলোচিত সাখাওয়াত হোসেন খানকে প্রার্থী মনোনীত করে তার পক্ষে জোর প্রচারণায় নেমেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এজন্য বিএনপি ও ২০ দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে পৃথক কমিটি গঠন করা হয়। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও প্রচার কাজ চালানো হয়। তবে ধানের শীষের প্রার্থীকে ‘ক্লিন ইমেজের’ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করলেও জেলা বিএনপির বর্তমান কমিটির কোনো পদধারী না হওয়ায় বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি দলের সংশ্লিষ্ট নেতারা। নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে ভোটের দুই-একদিন আগেও বিভিন্ন কারণে স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাখাওয়াতের কিছুটা দূরত্ব ছিল বলে জানা গেছে। এজন্য কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলীয় নেতারা তার পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করলেও বাস্তবে তার পুরোপুরি মিল ছিল না। ভোটের ফলেও এ প্রভাব পড়তে পারে বলেও সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর ব্যক্তিগত ইমেজের পাশাপাশি তার পক্ষে দলের নেতাকর্মীদের শক্ত অবস্থানের কারণে জয়লাভ সম্ভব হয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নাসিক নির্বাচনের সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক গয়েশ্বর চন্দ্র রায় শুক্রবার রাতে তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নির্বাচনের ফল অপ্রত্যাশিত। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। যারা আমাদের পোলিং এজেন্ট ছিলেন এবং যাদের নির্বাচনে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অপ্রত্যাশিত এ ফলের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে আমরা দ্রুতই কাজ শুরু করব। তিনি বলেন, আমি লোকাল এজেন্টদের আবার ডাকব। যদি এমন কোনো কথা তাদের থেকে থাকে যা নির্বাচনের আগে বলতে পারেননি, সেকথাও শুনব। আমাদের অভ্যন্তরে কোনো সমস্যা ছিল কিনা তাও বের করার চেষ্টা করব।
একই বিষয়ে শুক্রবার নয়াপল্টনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নাসিক নির্বাচনের ফলের পেছনে মিডিয়া ক্যু হয়েছে বলে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দৃশ্যত নির্বাচনটা ফেয়ার, ফলটা আনফেয়ার। এ ফল অপ্রত্যাশিত এবং বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আমাকে এ আলামতই খুঁজতে হবেÑ এই ফলটা কীভাবে তৈরি হলো ও ফলটা কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা (গণমাধ্যম) প্রচার-প্রকাশ করল। এটা বের করার একটা দায়িত্ব আমার আছে।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফল মানছেন কিনা জানতে চাইলে গয়েশ্বর বলেন, আমরা মানি বা না মানি আইভী মেয়র। কিন্তু আমাদের যে প্রশ্নগুলো তা তো থেকেই যাবে।
ভোটের ফলে মিডিয়া ক্যু হয়েছে বলে নিজের তোলা অভিযোগের যৌক্তিকতার পক্ষে দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভালো ফলের কথা তুলে ধরেন তিনি।
নাসিক নির্বাচনের ফল প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের প্রচার কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, আমাদের প্রার্থীর এ ফলের পেছনে নেতাকর্মীদের ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে হেরে গেছি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর তুলনায় বিএনপির প্রচার কাজ যথেষ্ট হয়নি।
এর আগে শুক্রবার রাতে বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির কারণে ধানের শীষের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। একটি কেন্দ্রে ভোটের হিসাবের গরমিল হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এর বাইরে শুক্রবার আর তিনি তেমন কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাননি।
এদিকে নাসিক নির্বাচনের পরদিন শুক্রবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত দলের নেতাকর্মীদের মাঝে এ ফল নিয়ে চলে নানা মন্তব্য ও সমালোচনা। অনেকেই এ পরাজয়ের জন্য দলের ব্যর্থতাকেই দায়ী করে কিছুটা হতাশাও প্রকাশ করেন। দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী কৌশলী বক্তব্যে বলেন, নাসিক নির্বাচনে বাহ্যিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের বাতাবরণ সৃষ্টি করে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে, এতে সত্যিকারের গণরায়ের প্রতিফলন ঘটলে আমরা সেটিকে শুভেচ্ছা জানাই। তবে ধানের শীষের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের কারচুপির অভিযোগকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
তবে লিখিত এসব বক্তব্যের বাইরে নাসিক নির্বাচনের ফল নিয়ে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান রিজভী। একইভাবে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ফল আরও ভালোভাবে পর্যালোচনার পরই কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এ বিষয়ে নেতারা কথা বলা শুরু করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নাসিক নির্বাচনে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন সেলিনা হায়াৎ আইভী। অপরদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। তবে কাউন্সিলর পদে মোটামুটি ভালো ফল পেয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। সূত্রমতে, ২৭ ওয়ার্ডের মধ্যে তিনজন মহিলা কাউন্সিলরসহ ১৫টি পদে দলটির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। অপরদিকে ৬ জন মহিলাসহ ১৯ কাউন্সিলর পদে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

Recent Posts

Leave a Comment