সম্ভাব্য ক্রেতাদের হাঁক দিয়ে ডেকে দামদর করছে দেখে আমরা দাঁড়াই। সোহেল বলে, রাস্তা থেকে খাসি কেনা কী বেআইনি হবে? আমি অজ্ঞতা প্রকাশ করি এ বিষয়ে। এর কিছুক্ষণ পরই চার-পাঁচজন তরুণ এসে ছাগল বিক্রেতাদের ওপর চোটপাট শুরু করে দেয়। একেবারে পুলিশি কায়দায় জেরা করতে থাকে তাদের। কেন ‘হাটে’ না গিয়ে রাস্তায় ছাগল বিক্রি করছে?
লোকগুলোকে রীতিমতো ধমকিয়ে, দাবড়িয়ে, টেনেহিঁচড়ে তারা নিয়ে যেতে থাকে ‘হাটে’। আমরা কিছু অসহায় লোক দাঁড়িয়ে কিংবা হাঁটতে হাঁটতে দেখি দৃশ্যটা। সোহেল বলে, ‘রেজিম চেঞ্জ’ হলে এরাই আবার আরেক দল বা গোষ্ঠীর হয়ে যাবে।
সেও আমার মতো পলিটিক্যাল ইকোনমি পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন আর রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত একটি গোষ্ঠী কীভাবে অর্থকড়ি উপার্জন করে আর কী থেকে তারা কী হয়ে যায়, এইসব নিয়ে পুরনো কথা নতুন করে বলতে থাকে সোহেল। তার কথা শুনতে শুনতে ক্লান্তি এসে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে মোড়ে আসতেই দেখি ওই ছেলেদের কথিত হাট। ওইভাবে এনে জড়ো করা বেশ কিছু ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোবেচারা বেপারিরা। তাদের চোখেমুখে বাড়তে থাকা দুশ্চিন্তাও লক্ষ করি। কারণটা স্পষ্ট, সেদিন সকাল থেকে রাজধানীতে গরু-ছাগলের দাম কমে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল।
অর্থশাস্ত্রের দুই ব্যর্থ ছাত্র আবার কথা বলতে থাকি ‘স্পেকুলেটিভ মার্কেট’ নিয়ে। প্রতিবেশী দেশ থেকে শেষ মুহূর্তে গরু আসছে বা নিয়ে আসা হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও। এরই মধ্যে দেখি রাস্তার ধারে ওভাবে হাট বসানো ছেলেদের কর্মকাণ্ড। তাদের হাতে কোনো স্লিপও নেই। দামের ওপর ছয় শতাংশ হারে ‘হাসিল’ আদায় করছে তারা। ছয় শতাংশ নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। সোহেলকে জিজ্ঞেস করি, পাঁচ শতাংশ না?
সে ততক্ষণে ওদের একজনকে ডেকে এক ধরনের অথরিটি নিয়ে জানতে চাইছে, তোমাদের এ হাট কী বৈধ? তরুণটি এ লাইনে বোধহয় নতুন এসেছে, ক্ষমতার রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছে অতি সম্প্রতি। তাই হয়তো একটু ঘাবড়ে যায় সে। সত্য কথাই বলে দেয় যে, ‘পুলিশ-টুলিশ ম্যানেজ করে আমরা এইখানে আপনাদের জন্য খাসি কেনার একটা ব্যবস্থা করছি’।
তাই নাকি কাগজপত্র নেই। দেখতে পেলাম, রুলটানা একটা খাতায় ‘হাসিল’ বাবদ আদায় করা টাকার অঙ্ক লিখে রাখছে তারা। কারও কারও কাছ থেকে একটু কমও রাখছে দেখলাম। যার কাছ থেকে যা পায় আর কী!
এসব দেখে ক্লান্ত হই না। সোহেলকে বলি, চলো দেখি সামনে আরও বড় ‘হাট’ পাই কিনা। বেশ রোদ পড়েছে। একটু আগে হয়ে গেছে হালকা বৃষ্টি। রাজধানীর প্রধান সড়কেও এখানে-ওখানে জমে আছে পানি। কোথাও কোথাও যোগ হয়েছে কোরবানির পশুর ফেলে যাওয়া বর্জ্য। একটা রিকশা নিই আমরা। চালককে বলি, এর চেয়ে বড় কোনো ছাগলের হাটে নিয়ে চলো।
তরুণ রিকশাচালক কাছেই যেখানে নিয়ে যেতে থাকে, তার মাঝেই পেয়ে যাই পুলিশের একটি ঝকঝকে টহল গাড়ির দেখা। সোহেলের সঙ্গত আপত্তির মুখেও রিকশা দাঁড় করিয়ে গাড়ির সামনে বসে থাকা অফিসারের কাছে যেয়ে ভদ্রভাবে বলি, মোড়ে মোড়ে ছাগল বিক্রেতাদের ধরে এনে হাট বসাচ্ছে পাড়ার কিছু ছেলেছোকড়া। তিনি নিজে থেকেই বললেন, ‘এগুলো তো অবৈধ’! বললাম, এদের একটু দাবড়ানি দেওয়া যায় না? অফিসার বললেন, দেখি।
তিনি ও তারা ওখানে এসে কীসের জন্য যেন দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ। তাদের রেখে আমরা এগিয়ে যাই হালালভাবে উপার্জিত অর্থে আট-দশ কেজি ওজনের একটা খাসি কিনতে। একটু এগিয়েই আরেকটি ‘হাট’ পাই। একটা পরিত্যক্ত জায়গায় চেয়ার-টেবিল নিয়ে বেশ একটু গুছিয়ে বসেছে আরেকদল তরুণ। এখানেও ছয় শতাংশ হারে ‘হাসিল’ আদায় করে তারা আবার স্লিপ দিচ্ছে ক্রেতাদের।
সুন্দর করে জানতে চাইলাম, এটা কি সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ডেকে নেওয়া হাট? নতুন গোঁফ-দাড়ি গজানো ছেলেটি ‘আঙ্কেল’ সম্বোধন করেই বলল, জ্বী-না। বলল, কমিশনারের অনুমতি নিয়ে তারা ‘হাসিল’ আদায় করছে। কমিশনার কে, জানতে চাইলে তার নাম বলল সে বেশ গর্বের সঙ্গে।
আরেক তরুণ দেখি ছাগল কিনে নিয়ে যাওয়া একজনকে আটকে তার কাছে স্লিপ দেখতে চাইছে। সঙ্গে থাকা অন্যজন খুব গুরুত্ব দিয়ে বলছে, ‘ঠিকমতো হাসিল দিবেন কিন্তু। হাসিল না দিলে কোরবানি অইব না’।
অগত্যা আমরাও হাসিল দিই ৪৫০ টাকা, ছয় শতাংশ হারে, ‘ঠিকমতো’। হরিণরঙা একটা খাসি কেনা হলে সোহেল সেটার দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। টিপটিপ বৃষ্টি বুঝি শুরু হয় আবার। একটা রিকশায় সে তুলে দেয় আমাকে। খাসিটাকেও।
রিকশাচালক খাসির দাম জানতে চায়। হাসিল কত নিল, সেটাও। বলল, ‘খাসি ভালোই অইছে। হাাসিলডা খালি ফাও-ফাও দিলেন’। বললাম, দিলাম আর কী! ওদেরও তো ঈদ করতে হবে।
দ্রুতই চলে আসি আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির গেটে। খাসিটা সযত্নে নামিয়ে দেয় চালক। গার্ড এসে নিয়ে যায়। বেঁধে রাখে নিরীহ পশুটাকে। গেটের বাইরে এসে দশটা টাকা বেশি দিই রিকশাচালককে। মনে মনে বলি, খেটে খাওয়া একজন মানুষকে ঈদের শুভেচ্ছা।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
hmamun67@gmail.com