কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ ভারতীয় সেনা নিহত

 In দেশের বাইরে

কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে উরিতে গতকাল সন্ত্রাসী হামলার পর একপর্যায়ে সতর্ক অবস্থানে ভারতীয় এক সেনা l ছবি: এএফপি

প্রতিনিধি ।। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে প্রায় দেড় দশকের মধ্যে গতকাল রোববার সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ জনের বেশি। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার পাশে উরিতে ভোরে সেনাবাহিনীর ১২ ব্রিগেডের সদর দপ্তরে চার সশস্ত্র জঙ্গি এই হামলা চালায়।

এই হামলার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সন্ত্রাসীদের ‘অব্যাহত ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতার’ জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেন। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলায় জড়িত থাকার ভারতীয় অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে সেনা-জঙ্গি লড়াইয়ের পর চার জঙ্গিই নিহত হয়। গতকাল বিকেলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিহত জঙ্গিরা সবাই বিদেশি এবং তারা প্রত্যেকেই জঙ্গি সংগঠন জইশে মুহাম্মদের সদস্য। আহত সেনাসদস্যদের হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১০০ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগরে। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
কাশ্মীরের এই হামলাকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যায়িত করে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এর নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত সন্ত্রাসী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের অপতৎপরতা ব্যর্থ করে দেবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ঘটনার পর টুইট করে বলেন, যারা এই কাপুরুষোচিত ঘটনার জন্য দায়ী, তারা উপযুক্ত শাস্তি পাবে। ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও।
কাশ্মীরে হামলায় নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জন কারবি এক বিবৃতিতে বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে নিবিড় ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন এ হামলার নিন্দা করে বলেছেন, যুক্তরাজ্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে ভারতের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে।

হামলার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের ‘অব্যাহত ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতার’ জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলায় জড়িত থাকার ভারতীয় অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে

চার জঙ্গি ভোর পাঁচটায় স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়ে উরিতে সেনা সদর দপ্তরে ঢুকে পড়ে। ওটা ছিল ‘চেঞ্জ অব কমান্ডের’ সময়। অর্থাৎ, এক দলের ডিউটি শেষ, অন্য দলের ডিউটি শুরু। অধিকাংশ সেনাই সে সময় তাঁদের ছাউনিতে ঘুমাচ্ছিলেন। আচমকা গ্রেনেড হামলা এবং এলোপাতাড়ি গুলিতে তাঁদের অনেকেই নিহত ও আহত হন। বেশ কয়েকটা ছাউনিতে আগুনও ধরে যায়। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, আগুনে অনেকে পুড়ে গেছেন। ছয় ঘণ্টা লড়াই শেষে চার জঙ্গিই নিহত হয়। বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গোটা এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। খোঁজ চলছে আর কোনো জঙ্গি ওই চারজনের দলে ছিল কি না।
সাতসকালেই এই জঙ্গি হানার খবর দিল্লিতে পৌঁছে যায়। গতকালই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল। এ ঘটনার পর সফর বাতিল করে দেন রাজনাথ। যোগাযোগ করেন জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও রাজ্যপাল নরেন্দ্র নাথ ভোরার সঙ্গে। নিরাপত্তা নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর এবং সেনাপ্রধান দলবীর সিংয়ের সঙ্গেও কথা বলেন রাজনাথ। পারিকর ও দলবীর সিং কাশ্মীরেই রয়েছেন। বৈঠক শেষে রাজনাথ বলেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র। তাদের সেভাবেই পরিচিত করে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তিনি বলেন, জঙ্গিরা প্রত্যেকেই রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতে ঢুকেছিল।
রাজনাথ সিংয়ের এই অভিযোগের পরপরই এতে জড়িত থাকার অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাফিজ জাকারিয়া বলেন, এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলেই পাকিস্তানকে দায়ী করা ভারতের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে একাধিক হামলায় ভারতীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত থাকলেও ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র—রাজনাথের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নাফিজ জাকারিয়া বলেন, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য ভারত এখন চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গত জুলাই থেকে কাশ্মীর অশান্ত। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীনের তরুণ নেতা বুরহান ওয়ানি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর কাশ্মীরে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভে এ পর্যন্ত ৮৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
মাত্র কদিন আগেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র বলেছিলেন, প্রায় ৩০ জনের একটি সশস্ত্র জঙ্গি দল নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছে। তারা বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে হামলার ছক কষছে। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি গতকালের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, কাশ্মীরে একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান রেষারেষিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কাশ্মীরের। কাশ্মীরি জনগণ ছয় দশক ধরে ওই রেষারেষির মাশুল দিয়ে আসছে।
আজ সোমবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে। ঠিক এ সময়েই কাশ্মীরে হামলার এ ঘটনা ঘটল। এই অধিবেশনে চির বৈরী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান তুলে ধরবে। পাকিস্তান কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত এই অধিবেশনে বেলুচিস্তানের প্রসঙ্গ তুলে ধরতে চায়। বেলুচ জনগণ পাকিস্তানের কাছে থেকে স্বাধীনতা চায়। এতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি প্রাধান্য দিতে চায় ভারত।
২০০২ সালে শ্রীনগর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে কালুচকে সেনানিবাসে তিন জঙ্গি হানা দিয়েছিল। সেনাসদস্য ও তাঁদের পরিবারের ৩০ জন সেই আত্মঘাতী হামলায় মারা গিয়েছিলেন। তারপর উরির এই হামলায় এতজন প্রাণ হারালেন। গতকাল সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিহত জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রে পাকিস্তানের ‘ছাপ’ রয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে চারটি একে-৪৭ ও গ্রেনেড। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই গোষ্ঠীই ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোটের বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ করে আসছে ভারত। ওই হামলায় সাত ভারতীয় সেনা নিহত হন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লে. জেনারেল অসীম সালিম বাজওয়া বলেন, হামলার ঘটনার পর দুই দেশের সামরিক অপারেশন মহাপরিচালকেরা (ডিজিএমও) হটলাইনে নিয়ন্ত্রণরেখার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।
পাকিস্তানে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ভারতীয় পক্ষের ভিত্তিহীন ও অপরিণত অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে পাকিস্তানের ডিজিএমও তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষের কাছে এ বিষয়ে বাস্তব গোয়েন্দা তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’
জেনারেল অসীম বাজওয়া বলেন, সীমান্তের উভয় পাশেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা থাকায় পাকিস্তান থেকে কাউকে ভারতে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

Recent Posts

Leave a Comment