সর্বশেষ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষ করে শনিবার বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। দুই দিনের সফরের প্রথমদিনই সাবেক প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তার। অথচ বর্তমান প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বা জাতীয় পার্টির কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে কোনো অফিসিয়াল বৈঠক হয়নি চীনা প্রধানের। এর আগে চলতি বছর আগস্টে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সরকারি সফরে এলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়নি। গত বছর জুনে বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার সৌজন্য সাক্ষাৎ হলেও তা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব পায়নি।
সর্বশেষ চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোনো বৈঠক না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরাও। জাতীয় পার্টির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল কোনো বৈঠক নির্ধারিত না থাকাটাকে অপমানজনক বলেও মনে করছেন তারা।
এ ব্যাপারে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোনো বৈঠক সিডিউল না থাকা, এর আগে জন কেরির বাংলাদেশ সফরেও একই ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য হতাশা ও লজ্জাজনক। আমাদের মনে হচ্ছে- বিরোধী দল হিসেবে আন্তর্জাতিক মহল আমাদের পাত্তা দিচ্ছে না। এটা দলের জন্য, দলের নেতাকর্মীদের জন্যও নেতিবাচক। স্বাভাবিকভাবে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান সফরে এলে সরকারি দলের পাশাপাশি দেশের প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গেও একটা অফিসিয়াল বৈঠক করে। সেই বৈঠকটা শুধুমাত্র সৌজন্য সাক্ষাৎই না, রাজনৈতিক গুরুত্বও বহন করে। কিন্তু আমরা দেখছি জাতীয় পার্টিকে সেই গুরুত্বটা দিচ্ছে না। এতে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে বিরোধী দল হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতার সংকট রয়েছে।’
দলের এমন সংকটের কারণ জানতে চাইলে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সরকার ও বিরোধী দলে দ্বৈত অবস্থান নাকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অথবা দলের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে এমন হচ্ছে সেটা আমি বলতে পারব না। এ বিষয়ে দলের চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতাই ভালো বলতে পারবেন।’
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজমুদার বলেন, ‘জাতীয় পার্টির দ্বৈত অবস্থানের কারণেই তারা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এখানে জাতীয় পার্টির অবস্থান স্পষ্ট না। জাতীয় পার্টির নেতারা সরকারের মন্ত্রিপরিষদেও আছেন আবার সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেও আছেন। এটা কোনো অবস্থান হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মহল মনে করে সরকারের বিপরীতেই বিরোধী দল হবে। যখন কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশ সফর করেন, তখন তাদের উদ্দেশ্য থাকে সরকার ও বিরোধী দলের মনোভাব জানা। এরপর তারা বিনিয়োগসহ অন্যান্য সহযোগিতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় পার্টি তো সরকারেও রয়েছে, তাই তাদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে না আন্তর্জাতিক মহল। আর অবশ্যই এটা জাতীয় পার্টির জন্য লজ্জাজনক। তাদের আইডেনটিটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বিরোধী দলের সংজ্ঞাতেই তো জাতীয় পার্টি পড়ে না। তাদের আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত তারা কি করবেন। হয় তাদের বলতে হবে আমরা সরকারের অংশীদার অথবা বলতে হবে আমরা বিরোধী দল। কিন্তু দুটো পরিচয় নিয়ে হয়ত বাংলাদেশে থাকা যায়, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তারা কখনোই পাত্তা পাবে না। জাতীয় পার্টির অবস্থান শুধুমাত্র বাংলাদেশ না বিশ্বের মধ্যে একটা ইউনিক (একক) উদাহরণ।’
তিনি বলেন, ‘যখন বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান সফরে আসেন তখন তারা মনে করেন, সরকারের সঙ্গে বৈঠক করাটাই যথেষ্ট। নতুন করে জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোনো বৈঠকের প্রয়োজন নেই। আসলে এখনও জাতীয় পার্টির সময় আছে, আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা। হয় তাদের সরকারের সঙ্গেই থাকতে হবে না হয় পুরোপুরি বিরোধী দল হিসেবেই থাকা উচিত তাদের।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘যখন আমরা এক জোট হয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করেছি, তখন আমাদের একটায় কথা ছিল কখনোই জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করা যাবে না। সেই শর্তানুযায়ী আজ এরশাদ, রওশন এরশাদসহ পুরো জাতীয় পার্টির জেলে থাকার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি উল্টাটা। একদিকে রাজাকার জোট অন্যদিকে স্বৈরাচার জোট। জাতীয় পার্টির তো রাজনীতিই করার অধিকার নাই, তারপর না হয় আসবে তারা বিরোধী দল নাকি সরকার দল। জাতীয় পার্টির লজ্জা নাই, ঠিক তেমনি যারা এই স্বৈরাচারকে নিয়ে জোট করে তাদেরও লজ্জা নাই।’
জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।