কাদের পলাশ এর গল্প -আগভাত

 In শিল্প-সাহিত্য

মা কখনোই পাতিলের প্রথম চামচ ভাত আমায় দিতেন না। তিনি আমার জীবনের অনেক আবদার রক্ষা করেছেন শুধু এটা বাদে। ঘরের মধ্যে আমি সবার ছোট। তাই সময় হলে খাবার ঘরে আমি-ই সবার আগে উপস্থিত হতাম। সবার আগে আমার থালা প্রস্তুত। অথচ কখনোই প্রথমে ভাত পেতাম না। এ নিয়ে মায়ের প্রতি ভীষণ অভিমানও ছিল। প্রতিদিনই থালায় আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে ভাবতাম, মনে হয় আজ মা আমায় সবার আগে ভাত দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আশা পূর্ণ হতো না। দাদা বা বড় আপুর পর ভাতের চামচ আমার থালায় আসতো। তখন আমার খুব রাগ হতো। অবশ্য ভেতরের রাগ চাপা দিতাম বুকের ভেতরই। মা আগভাত বঞ্চিত করায় সুযোগ খুঁজতে থাকলাম; কিভাবে আগভাত খাওয়া যায়।
নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের কৌতুহল থাকে বেশি। বিশেষ করে যে কাজটি করতে বাধা দেয়া হবে সেটাই করতে তাদের বেশি ইচ্ছে হয়। এটা শিশু চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দিন দিন আগভাতের প্রতি আমার কৌতুহল খুব তীব্র হতে থাকে। সুযোগ খুঁজতে থাকি কীভাবে আগভাত খাওয়া যায়। খাবার ঘরে ঢুকতেই কখনো মা, কখনো বাবা কিংবা ভাই-বোন বা দাদা এসে হাজির। কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছিলো না। লোভটাও দিন দিন তীব্র হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত একদিন সুযোগ বুঝে পাতিলের ঢাকনা উল্টে একমুঠো ভাত নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই। বাড়ির পাশের সুপারি বাগানে গিয়ে লুকিকে লুকিয়ে ভাতগুলো মুখে দিয়ে চিবুতে থাকি। লবন ছাড়া ভাত ভালো লাগার কথা নয়। ভালো লাগলোও না। মনে মনে মাকে খুব বকা দিতে খুব ইচ্ছে করলো। যদিও নিজেকে নিজেই বললাম, এমন ভাত মাইনসে খায়? একটুও হাদ নাই; হোয়াদ নাই। অথচ আগভাতের জন্যে মা এমন ভাব দেখাতেন যেন রসগোল্লা; কিংবা বিলাতি খাজুর।
যাহোক; আগভাত খেয়ে সহসাই ঘরে ফেরা হলো না। ভয়ে ভয়ে সন্ধ্যার একটু আগে ঘরে আসি। আমি আগভাত খেয়েছি কিন্তু কারো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সন্ধ্যার পর ভাই ও আপুদের সাথে আমিও পড়তে বসি। মা পেছন থেকে এসে আমার দু’হাত ধরে বললেন, আগভাত খাইছিলি?
আমি ভয়ে সত্য বলে দিই। হ খাইছি। এট্টুও হাইদ-হোয়াদ নাই। ইচচচ…, এডি মাইনসে খায়?
মা আর কোনো কথা না বলে নারিকেল পাতার সলা দিয়ে ইচ্ছে মতো মারলেন। আমার চিৎকারে বাড়ির সবাই আমাদের ঘরে জড়ো হলো। চাচি জেঠিরা মায়ের হাত থেকে সলার মুঠা সরিয়ে নিলেন। এ যাত্রায় আমিও বেঁচে যাই।
সেদিনের শিক্ষার পর আর কখনো আগভাত খাওয়ার মন বাসনা জাগেনি। শুধু আগভাত রহস্য জানতে ইচ্ছে করতো। তবে সাহস করে মা তো দূরের কথা, ভাই বোনকেও জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি। মাইরের সময়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি মা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই ভাতের মাড় গ্যলেই ঢাকনার নিচের উচু ভাতগুলো আলাদা করে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখতেন। এই আগভাত বড় ভাই কিংবা বোনদেরও দিতেন না।
একদিন স্কুলের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হই। কিন্তু স্কুলে না গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় আড্ডা দিয়ে দুপুরের দিকে এসে নীরবে ঘরে ঢুকি। ঘরে ঢুকতেই দেখি মা জায়নামাজ ঘুচাচ্ছেন। পরে খাবার ঘরে ঢুকলেন। আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে মায়ের উপর চোখ রাখি। আজ অবশ্যই দেখতে পাবো মা আগভাত কী করেন? ছিক্কায় ঝুলতে পাতিল বাটি নামিয়ে কিছু ভাত থালায় নিলেন। পরে পাতিল থেকে আরো কিছু ভাত নিয়ে খাওয়া শেষ করলেন। অবশ্য মাঝে মাঝে শুনেছি আগভাত বৃদ্ধ দাদাকে দিতেন। দেখেছিও। প্রতিদিন দাদাকে ভাত দিতে হতে না। কারণ বাপ-চাচারা ছয় ভাই। তাই বিপতিœক দাদা একদিন এক ছেলের ঘরে ভাত খেতেন। সে হিসেবে আগভাত মা খেতেন পাঁচ দিন আর দাদা একদিন।
মা আর দাদা আগভাত খান, তাতে কী? মনের মাঝে আগভাত রহস্য জানার খুব ইচ্ছে রয়েই গেছে। আমার সমবয়সী অনেককেই জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি। একদিন খাবার সময় খুব সাহস হঠাৎ করে বলে ফেলি, মা আগভাত খাইলে কী অয়? মা কোনো জবাব দিলেন না। আবার জানতে চাইতেই ধমক দিয়ে বললেন, ভাত খাইয়া তাড়াতাড়ি উঠ। বেশি কতা কস্ ক্যান?
ধমক খেয়ে তৃতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস সঞ্চার করতে পারিনি। কিন্তু আগভাতের প্রতি আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে।
বাবা জীবনের তাগিদে দেশের বাইরে থাকতেন। আমার জন্মের একবছর পর তিনি প্রবাসে চলে যান। তাই মায়ের আদর আর শাসনের মাঝে বড় হয়ে উঠা। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। তাই আগভাত রহস্য আর উন্মোচন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে; তাই এসব বাদ দিয়ে স্কুলের প্রতি মনোযোগী হই। প্রতিদিন সকালে গরম ভাত খেয়ে প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। প্রায় দেড়ঘণ্টার পথ। একদিন কোচিংয়ের ফাঁকে স্কুলের হেড স্যার ক্লাসের সবার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তখন নিয়ম ছিল ক্লাসের এক থেকে চল্লিশ রোল যাদের, তারা বৃত্তি পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করতে হবে। আমার রোল নম্বর সতের বলে আমিও এ নিয়েমের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত ছিলাম। ক্লাসে ভালো-মন্দের মিশিলে ছাত্র ছিলাম।
হেড স্যার একজন একজন করে ক্লাসে উপস্থিত সবার জীবনের লক্ষ্য জানছিলেন। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়র, কেউ ম্যাজিস্ট্রেট, জজ-ব্যারিস্টার কিংবা কেউ স্কুল শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো। আমার বন্ধু তারেকও তার জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলে ফেলল। এবার আমার পালা। আমি হাবাগোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কী বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। কারণ কখনো ভাবতেই পারিনি জীবনে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এমন হবে জানলে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবশ্যই মাকে আগে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতাম। শেষ পর্যন্ত স্যারকে বললাম, স্যার, আমি মাকে জিজ্ঞেস করে এসে কাল বলবো।
আমার এমন জবাবে হেড স্যারসহ ক্লাসের সবাই খুব মজা পেলেন। খুব হাসলো সবাই। আমি খুব লজ্জা পেলাম। সেদিন আর আমার পরে জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চায়নি স্যার। তোমার জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে রচনা পড়াতে শুরু করলেন।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মায়ের কাছে জানতে চাই, আমি বড় হয়ে কী হবো?
মা প-িতের মতো জবাব দিলেন, অনেক বড় হবি। বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবি। অন্তত এ কথাটা মা খুব শুদ্ধ করে বলতে পারলেন। একাত্তর সালের আদর্শলিপি পাস মায়ের মুখে এমন শুদ্ধ কথা শুনে মনটা ভরে গেলো। অবশ্য মা আমার জীবন নিয়ে আর কিছু বললেন না। কারণ জীবন চলে যায়। লক্ষ্য থাকলেও যায়, না থাকলেও যায়। জীবন কখনো থেমে থাকার নয়।
মায়ের এমন কথায় আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে যেহেতু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র হতে হবে না, তাই লেখাপড়াও বেশি করতে হবে না এটা বুঝতে সমস্যা হলো না। শুরু হলো স্কুল ফাঁকি দেয়া। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মায়ের হাতের কতদিন মার খেয়েছি, তার হিসেব নেই। তবে মারের চেয়ে বকুনী হজম করতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি। হরেক রকমের গালিগালাজ জানতেন আমার মা। গালিগালাজের প-িত তিনি। যা জানতেন, তার সিংহভাগ আমার পেছনে ব্যয় করতেন। অবশ্য তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। কারণ, আমার ধারণা দিন দিনতো বড় হচ্ছিই। বড় হতে পড়ালেখার দরকার কী?
সেদিন দূরসম্পর্কের এক দাদাকে কথায় কথায় জিজ্ঞাস করলাম, আচ্ছা দাদা আগভাতের রহস্য জানেন?
দাদা বোধ হয় আমার প্রশ্ন বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, মানে?
-আগভাত কারা খায়? কেন খায়? এসব আরকি।
দাদা বললেন, আগের মাইনসে কইতো, যে আগভাত খাইবো সে আগে মারা যাইবো। তাই ঘরের সবচেয়ে বড় যে সে খায় আগভাত। ছোডরা আগভাত খায় না। কথাগুলো শুনে আমার ভেতরটা যেন হঠাৎ কেঁপে উঠে। থেমে থেমে কাঁপে। আমার সাদাসিদে মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমি যেন দেখতে পাই- সৌম্য মুখ নিয়ে মা আমার আড়ভাত খাচ্ছেন!

Recent Posts

Leave a Comment