নারীরা যৌন হয়রানির, নিগ্রহের, নিপীড়নের শিকার হলে কখনও কখনও, কেউ কেউ তা প্রকাশ করে। প্রতিবাদ করে। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে বরাবরই যৌন হয়রানির ঘটনা অপ্রকাশ্য। পুরুষ কিছুতেই এ ঘটনা প্রকাশ করে না, বলে না কাউকে। সে অদ্ভুত এক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় ভোগে। ভোগে পুরুষিক হীনমন্যতায়। সমাজ তাকে ধারণা দিয়েছে, যদি তুমি যৌন হয়রানির শিকার হও, যদি তা প্রকাশ করো, তবে তুমি পুরুষ নও। পুরুষ কেন হয়রানি হবে, পুরুষ হয়রানি করবে। তথাকথিত পুরুষের কৃত্রিম, মিথ্যা, ভ্রান্ত ধারণা তাকে যৌন হয়রানির প্রতিবাদও করতে দেয় না। আমি কখনোই তথাকথিত পুরুষ হতে চাইনি, ছিলাম না, এখনও নয়। বরাবরই চেয়েছি মানুষ হতে, মানবিক হতে, মানবিকতার সৌন্দর্যই আমাকে আকর্ষণ করেছে। লৈঙ্গিক পরিচয় প্রাধান্য পায়নি, প্রাধান্য পেয়েছে মানুষ ও মানবিকতা চিরকাল।
আমাদের বসবাস বড় অবদমিত এক সমাজে। যৌনতা এখানে অপরাধী এক শব্দ। প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলা বারন। রীতিমতো অন্যায় অপরাধ বলে ভাবে লোকে। বিষয়টিকে যতবেশি আড়ালে রাখা যায়, রাখ-ঢাক করা যায়, ততই বুঝি মঙ্গল। ফলে আলোচনা, লেখাপড়া, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ এখানে নেই। সুযোগ রয়েছে পর্নোপত্রিকা থেকে, পর্নোগ্রাফি থেকে যৌনতার ভুল পাঠ নেবার। ভুল শিক্ষা নেবার। ফলে স্বাভাবিকতার বদলে বিকৃতি বাড়ে ভেতরে ভেতরে।
মনে আছে, বয়স যখন খুব কম, স্কুলবালক আমি, স্কুলেরই এক পরিচারিকা আদর করতে করতে আমার ঠোঁটটি নিয়ে নেয় তার ঠোঁটের ভেতরে। কেমন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ছেড়ে দেয় সে। বড় হয়ে বুঝতে পারি ‘পেডোফিলিক’ ছিলেন এই মহিলা। সাইকোসেক্সুয়াল ডিসঅর্ডার, পেডোফিলিয়া। শিশুদের যৌন উৎপীড়নেই আনন্দ তাদের, তাদের সুখ।
আরেকবার, এক সহপাঠী মেয়ে, কোচিং করতাম একসঙ্গে, তার বাবা এরশাদের মন্ত্রীও ছিলেন দু’দুবার। একবার ভূমিমন্ত্রী, আরেকবার মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী। মেয়েটি তার জন্মদিনের মিথ্যে কথা বলে আমায় নিয়ে গিয়েছিল তাদের ১নং মিন্টো রোডের বাসায়। মন্ত্রিপাড়া, বিশাল বাড়ি। কী আশ্চর্য! কোথাও তো জন্মদিন আয়োজনের কোনো জাকজমক নেই। কিন্তু মেয়েটি চকচক করছে। আমায় নিয়ে গেল একেবারে তার নিজের ঘরে। জুস আসলো, মাল্টা, আপেল, কেক আরও কী কী যেন মনে নেই। বসে বসে জুসের গ্লাস শেষ করছি, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই পাশে বসা মেয়েটি আমাকে অতর্কিত জাপটে ধরে এখানে সেখানে চুমু খেতে থাকে। প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও, এ পরিস্থিতির জন্য। ছুটে বেরিয়ে এসে মুক্ত বাতাসে, দম নেবার চেষ্টা করলাম। এতো অনেক আগের অভিজ্ঞতা, তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। এমন অভিজ্ঞতা আমার অনেকবারই হয়েছে। অনেকবারই বিব্রত। কী ভীষণ দুর্বিষহ দুর্বিপাক!
আর ক’দিন আগে ইউসিবি ব্যাংকে কর্মরত এক মেয়ে আমাকে মেইল করেছে, আমার লেখা তার ভীষণ ভালো লাগে। দারুণ ভক্ত, আমার অনুরাগী পাঠক সে। তাকে যেন ফেসবুকে অ্যাড করে নিই, অমন ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট অনেকদিন পেন্ডিং হয়ে আছে। প্রথমে আমার নারীবাদ ভালো লাগে, পরে আমাকে ভালো লাগে, আরো আরো আরো পরে আমি সুদর্শন, সুপুরুষ, আমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করে … । শেষতক বাধ্য হই তরুণীকে ব্লক করতে।
আমি নিশ্চিত, যদি একই আচরণ কোনো নারীর প্রতি আমার হতো তবে তা যৌন হয়রানি বলে এতক্ষণে টিভি স্ক্রল হয়ে, মুখরোচক খবর হতো। বুঝতে পারি না, পুরুষের নিপীড়ন যৌন হয়রানি কিন্তু নারীকর্তৃক পুরুষের প্রতি যেকোনো অশ্লীল ইঙ্গিত, যৌন আহ্বান, কেন নিপীড়ন নয়, যৌন হয়রানি নয়? নাকি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই এমনটি ভাববার মূল কারণ। নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে আইন আছে, বিচার আছে, শাস্তি আছে। আমি যৌন হয়রানির শিকার হলে, কী শাস্তি, কী বিচার, কী আইন আছে?
অনেকেই আমাকে ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা করতে পারেন। ভাবতে পারেন, বলতে পারেন, নারীর যৌন ইশারায়, ইঙ্গিতে, আহ্বানে আপত্তি কেন আমার? না কোনো আপত্তি নেই, আগ্রহ আছে। নারী সঙ্গ এবং সঙ্গম দু’টোই আমার প্রিয়, কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যেকোনো সময়, যে কারও সঙ্গে নয়। যদি সম্পর্ক না থাকে, না থাকে প্রেম, তবে কিসের সঙ্গম? কিসের মিলন? কিসের কাম? মিলনে আপত্তি নেই। তবে আগে তো মনের মিল প্রয়োজন। আমি তো যৌনবস্তু নই, যে কারও যৌন চাহিদা মেটাতে, চরিতার্থে বাধ্য। আমি মানুষ, স্বাধীন, মুক্ত মানুষ। সম্পর্ক নেই, ভালোবাসা নেই, প্রেম নেই, অমন কাউকে ছুঁতে পারি না, শুতে পারি না আমি।
এখানে যৌনতার স্বাধীনতা অনেক বেশি ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়। ফ্রি সেক্স, সেক্স ফ্রি, ফ্রিডম অব সেক্স প্রতিটি কথার অর্থ আলাদা। যৌনতার স্বাধীনতা মানে যার তার সঙ্গে শোয়া নয়, যেখানে সেখানে যে কারও সঙ্গে না শোবার স্বাধীনতা, অধিকার। আমি প্রকৃত সমতায়, মানুষের মর্যাদায়, যৌনতার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। প্রেমে বিশ্বাসী, বিশ্বাসী ভালোবাসায়, বিকৃত খাবলাখাবলিতে নয়।
প্রেম নেই, ভালোবাসার সম্পর্ক নেই, এমন কোনও পুরুষ যদি কোনও নারীকে যৌন ইঙ্গিত করে, ইশারা দেয় তা যেমন যৌন হয়রানি তেমনি কোনও নারী যদি সম্পর্ক নেই, বোঝাপড়া নেই এমন কোনও পুরুষের প্রতি যৌন আহ্বান করে, ইঙ্গিত করে, যৌন উত্তেজনা ছড়াতে চায়, তা কেন যৌন হয়রানি নয়?
জব্বার হোসেন : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
jabberhossain@gmail.com