দরকার ছিল বেঈমানদের তালিকা : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

 In শিল্প-সাহিত্য
হাতীটি স্বেচ্ছায় আসেনি, এসেছিল নিতান্ত বাধ্য হয়ে, বন্যায়-প্লাবনে, ভাসতে ভাসতে। সাঁতরে, হেঁটে, কয়েকশ’ মাইল পার হয়েছে। আশ্রয় খুঁজেছে। পায়নি। শেষ পর্যন্ত মারাই গেল। শরণার্থীরা ওভাবেই একদেশ থেকে আরেক দেশে যায়। সখ করে যায় না, যায় উৎপাটিত হয়ে। গিয়ে আশ্রয় খোঁজে। এবং বিপদে পড়ে। সবাই যে প্রাণ হারায় তা নয়, তবে অধিকাংশেরই দশা হয় অর্ধমৃতের। হাতীটা দলছুট হয়েছে। একাকী ছিল। নিঃসঙ্গ বোধ করেছে, ৪৮ দিন ধরে ঘোরাফেরা করেছে। তারপর ক্লান্ত, অসুস্থ এবং উদ্ধারকারীদের তৎপরতায় উত্ত্যক্ত হয়ে মারা পড়েছে। আশপাশের মানুষ প্রথমে ভয় পেয়েছিল। ভয় পাবারই কথা। পাগলা হাতীরা ভীষণ ভয়ংকর হয়ে থাকে।

তাছাড়া বাঙালি সাধারণত ভয় পেয়ে থাকে। ভয় পেতে ভালোও বাসে। শত শত বছর ধরে বাঙালিকে অত্যাচার ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে; অজানা-অচেনাকে দেখলে সে তাই শংকায় পড়ে। ভাবে বুঝি বিপদ আসছে তেড়ে। হাতীর প্রতি বাঙালির মনোভাব নিয়ে একটা গল্প আছে। গল্প তো গল্পই, তবে এ গল্পটি তাৎপর্যবিহীন নয়। একটি হাতীকে বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখেছিল। তাদের মধ্যে একজন বাঙালিও ছিল। ছিল এক ইংরেজ, সে ভাবছিল হাতীটি অবশ্যই তাদের কোনো একটা কলোনি থেকে এসেছে। ছিল এক জার্মান, তার ভাবনা, দেখতে যাই হোক না কেন, হাতীটির রক্ত আর্য না হয়ে যায় না। ফরাসি দেশের লোকটি হাতীর মাংসের কোনো অংশটা রান্নার জন্য সবচেয়ে উত্তম হবে তাই নিয়ে চিন্তা করছিল। আমেরিকানটি ভাবছিল হাতীটিকে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার কী ব্যবস্থা করা যায়। আর বাঙালি? বাঙালিটির চিন্তা একেবারেই ভিন্ন রকমের। সে ভাবছিল হাতীটি চাপা দিয়ে মারবে না তো? শুনে হাসতে পারি, কিন্তু বাঙালির দুশ্চিন্তাটিকে যে হেসে উড়িয়ে দেয়া যাবে তা বোধ হয় নয়। বাঙালি চিরকালই গরিব, তার সম্পদ যা ছিল নিয়ে গেছে বিদেশীরা এবং গরিব মানুষ যদি ভয় না পায় তবে ভয় পাবে কে? গরিবের ঘরে হাতীর পা’র বিপদ-বিষয়ক প্রবচনটি তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি, তার বস্তুগত ভিত্তি আছে বৈকি। হাতীর চার পা নয়, পাঁচ পা দেখতেই বাঙালি অভ্যস্ত। তাছাড়া ঘরপোড়া গরুটির মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে যে প্রবচনটি প্রচলিত আছে সেটাও তো অযৌক্তিক নয়।

শরণার্থী হাতীটিকে দেখে লোকে তাই প্রথমে ভয় পেয়েছিল। সেটাই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। পরে দেখেছে হস্তীটি নিরীহ, কারো কোনো ক্ষতি করছে না, বাঘ-ভাল্লুক নয়, স্বভাবে মাংসাশী নয়। তখন তারা এগিয়ে এসেছে তাকে সাহায্য করতে, চেয়েছে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে। বাঁচাতে অবশ্য পারেনি। বাঁচানোটা তাদের ক্ষমতার বাইরে ছিল। উত্ত্যক্ত, ক্লান্ত, অসুস্থ অবস্থায় হাতীটি মারা গেছে। পারেরি, পারেনি নিজের দেহটিকে রক্ষা করতে। প্রাণটি বের হয়ে গেছে। বাঁচাবার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের ওপর। তারা এমনই অদক্ষ যে তাদের হস্তক্ষেপে হাতীটি শেষ পর্যন্ত মরে গিয়ে বেঁচেছে। কর্মচারীদের অদক্ষতার পুরনো শংকাটির যথার্থতা নতুন করে প্রমাণীত হয়েছে। রাষ্ট্রের লোকেরা কোনো কাজই ভালোভাবে করতে পারে না, মানুষকে পীড়ন করা ছাড়া। সামান্য একটা হাতীকে যারা উদ্ধার করতে পারল না, তারা শত শত লাইটার জাহাজ ভর্তি কয়লার হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করবে কি করে? তাদের হাতে রূপপুরে পারমাণবিক তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বা কতটা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে? উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মুখে মৃদু আওয়াজ শুনেছি, একমাত্র আল্লাহই ভরসা। তাও জোরে বলতে পারে না, ভয় পান, দেওয়ালেরও কান আছে। হাতীটিকে একটা নামও দেয়া হয়েছিল। কে বা কারা দিয়েছিল স্মরণে নেই, তবে নামটা শোনা গিয়েছিল। নামটি হল বঙ্গবাহাদুর। নামে যে দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, তবে দেয়া যায়, দেয়া হয়, রেওয়াজ আছে দেয়ার। প্রশ্ন থাকে কে বা কারা দেবেন? একজন পক্ষীপর্যবেক্ষকে জানতাম, পাখিদের খোঁজে-খবর রাখতেন, পক্ষীউৎসবও করতেন বছরে একবার, পাখিদের ওপর সুন্দর একটা বই লিখেছিলেন, তাতে অজানা কয়েকটি পাখির নাম দিয়েছিলেন স্বউদ্যোগে। প্রশ্ন উঠেছিল নাম দেয়ার অধিকার কি তার আছে? নামগুলো টেকেনি। তবে ওই যে কথা আছে অধিকার দেয় না কেউ হাতে তুলে, নিতে হয় নিজের হাতে রুদ্ধ দুয়ার খুলে, সে কথাটি তো মিথ্যা নয়। তবে অনেকে অধিকার জোর করে নিয়ে নেয়, যখন পারে। নাম দেয়, টিকুক না টিকুক। ‘বঙ্গবাহাদুর’ নাম টেকেনি। নাম টিকবে কি করে, নামের মালিক নিজেই তো টিকলো না।

বঙ্গবাহাদুর নামটি যারা দিয়েছিলেন তারা নিশ্চয়ই কৌতুক করছিলেন না। হাতীটি মোটেই বাহাদুরি দেখাতে চায়নি, সে উদ্দেশ্যে তার আগমন নয়। এসেছিল শরণার্থী হয়ে। শরণার্থীরা যেখানে যায় সেখানে কিন্তু একটা উপকার করে। শস্তায় নিজেদের বিক্রি করে দেয়, নানাভাবে। শরণার্থী হাতীটিও আমাদের উপকারে লাগতো। যেমন- কোনোমতে সাফারি পার্কে নিয়ে গিয়ে আটক করতে পারলে সে পার্কের আকর্ষণ ও মর্যাদা দুটোই বৃদ্ধি করতো। উপকারীকে বাঘে খাক না- খাক, শরণার্থীরা যে আদর-যত্ন পায় না সেটা খুবই ঠিক। হাতীটিই বা পাবে কেন? তার জন্য অবশ্য স্থানীয় কিছু মানুষ কেঁদেছে। হাতীটি তো কারো ক্ষতি করছিল না, কারো বাড়া ভাতে হাতও দিচ্ছিল না, তারা ভেবেছে। হাতীর দুঃখে তারা নিজেদের দুঃখ এবং পরিণতিও দেখে থাকবে।

বাহাদুর নাম প্রদান সম্বন্ধে সবাই জানতো কি না জানি না। না জানাই স্বাভাবিক। জানলে নামটা তাদের পছন্দ হতো না। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বীর পছন্দ করে ঠিকই, নিজেরা বীরের মতো কাজও করে, প্রয়োজন দেখা দিলে; কিন্তু তারা বাহাদুরি দেখলে খুবই বিরক্ত হয়। একাত্তরে তারা বীরের মতো লড়াই করেছে; ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবনের মুখে, ক্ষেতে-কারখানায়, সর্বদাই তাদের বীরত্বের সঙ্গে দাঁড়াতে হয়, তারা দাঁড়িয়ে থাকেও।

পাকিস্তান আমলে করাচির ইংরেজি ডন পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামের ওপরে, বাংলাভাষার প্রতি মায়া দেখিয়েই হবে, লিখে রাখতো ‘ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর।’ পত্রিকাটি যাদের মুখপাত্র সেই হানাদারেরা কিন্তু একাত্তরে আওয়াজ শুনলে ভয়ে কাঁপতো। ভাবতো ‘মুক্তি’রা এসে গেছে। হানাদারেরা লড়াই করেনি, মানুষ হত্যা করেছে। বীরের মতো লড়াই করেছে বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ। হাতীর মৃত্যুতে এরাই কেঁদেছে। বীরত্ব আর বাহাদুরি এক জিনিস নয়, একেবারেই ভিন্ন একটি অপরটি থেকে। বীরেরা বাহাদুরি দেখায় না, আর যারা বাহাদুরি দেখায় তারা বীর নয়, তারা বাহাদুরই শুধু। বীরেরা নীরবে কাজ করে, বাহাদুরেরা সারাক্ষণ লাফায়। বাংলাদেশ এখন বাহাদুরদের জ্বালায় ভীষণ বিপদের মধ্যে আছে।

প্রসঙ্গটা যখন উঠলোই তখন বলা দরকার যে, ক্ষেত-খামারে, কল-কারখানায় এবং বিদেশে গিয়ে মেহনতি বীরেরা নীরবে লড়াই করছে, আর তাদের ওই লড়াইয়ের কারণেই দেশের অর্থনীতি এখনও টিকে আছে, নইলে বাহাদুরদের উৎপাতে আমরা সর্বস্বান্ত হতাম। বাহাদুরদের বাহাদুরি বিশেষভাবে প্রকাশ পাওয়া শুরু করে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরের পর থেকে। তার আগের নয় মাস বাহাদুরি দেখিয়ে লুটপাট করেছে পাকিস্তানি হানাদারেরা, ষোলই ডিসেম্বর শুরু হল দেশীয়দের লুণ্ঠন তৎপরতা। ওর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে এর আগমন। যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াকু বীরেরা সরে গেছে, উন্মুক্ত বাংলাদেশে বাহাদুরেরা কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। হত্যা, জবরদখল, ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ সর্বপ্রকারের বাহাদুরিপূর্ণ কার্যক্রম এখনও সমানে চলছে। গতিবেগ হ্রাস পায়নি, বৃদ্ধি পেয়েছে। হানাদারেরা যা ইচ্ছা তাই করতো, বাহাদুরেরাও ঠিক সে রকমেরই কাজ-কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। জবাবদিহিতার দায় ওদেরও ছিল না, এদেরও নেই। হানাদারেরা ছিল বিদেশী, এ দেশের সম্পদ নিজেদের দেশে নিয়ে গেছে; এখনকার বাহাদুরেরা স্বদেশী, কিন্তু তারাও আমাদের সম্পদ বিদেশে পাচার করে। বিদেশকেই তারা স্বদেশ হিসেবে দেখে। বড় বড় বাহাদুরেরা ইতিমধ্যে বিদেশে ঘরবাড়িও তৈরি করে ফেলেছে। এ সব ব্যাপারে তাদের ভেতর হুড়োহুড়ি প্রতিযোগিতা।

একাত্তরে নীরব বীরত্বের একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ওই বিস্ফোরণের কারণেই হানাদারেরা অচিরেই পরাজিত হয়েছে এবং পালিয়েছে। দেশের শাসনভার যারা পেলেন তাদের জন্যও ওই বিস্ফোরণ ছিল মস্ত একটা অস্বস্তির কারণ। মানুষের এই বীরত্বকে তারা কী করে কাজে লাগাবেন, কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, এটা হয়ে দাঁড়াল দুশ্চিন্তার কারণ। কাজে লাগাবার পথঘাট তাদের মোটেই জানা ছিল না। কাজে লাগাতে হলে রাষ্ট্রকে আয়তনে ছোট করে সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব ছিল না, রাষ্ট্রের পুরনো যন্ত্রপাতি ফেলে দিয়ে, তার নিপীড়নমূলক চরিত্রের ইতি ঘটিয়ে তাকে জনগণের সেবকে পরিণত করাটা ছিল কর্তব্য। মানুষ সেটাই চেয়েছে। কিন্তু শাসকেরা তা চায়নি। মুখে যাই বলুক, তাদের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা পাওয়া এবং ক্ষমতা আটকে রাখা। সে কারণেই সাতচল্লিশে যা ঘটেছিল এবারও ঠিক তা-ই ঘটলো, ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল, রূপান্তরিত হল না। বাহাদুর হিসেবে যারা আত্মপ্রকাশ করলেন তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরেই ছিলেন, কলকাতাতে ছিলেন অনেকে, সেখানে বহু রকমের বাহাদুরি দেখিয়েছেন, বীরত্ব দেখাতে পারেননি।

জনগণের বীরত্বকে তারা বৈপ্লবিক ঝুঁকি হিসেবেই দেখলেন। দেখাটাই ছিল স্বাভাবিক। বীরত্বকে নিয়ন্ত্রণের ভেতরে আনার অস্থির চেষ্টায় তারা নানা প্রকার পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে দিলেন। কারো জন্য সুযোগ এনে দিলেন জবরদখলের, কাউকে দিলেন ডাবল প্রমোশন। শিক্ষার্থীদের জন্য পাস করা সহজ করে দিলেন- পঞ্চাশ নম্বরে পরীক্ষা নিয়ে এবং পরীক্ষায় নকলকারীদের শাস্তি না দিয়ে। পেটি-বুর্জোয়াদের জন্য পথ খুলে দিলেন দ্রুত গতিতে বুর্জোয়া হওয়ার। দাড়ি-গোঁফ না কামানো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট চললো। দরকার ছিল বেঈমানদের তালিকা তৈরি করা, তালিকা তৈরি করা শুরু করলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, যে কাজ এখনও শেষ হয়নি। অল্পকিছু দেশদ্রোহী ছাড়া দেশের সবমানুষই আসলে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের তালিকা নয়, তালিকা দরকার ছিল মুক্তিযোদ্ধাবিরোধীদের। তাহলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটা আপনা থেকে বের হয়ে আসতো। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বিলি করা এবং সার্টিফিকেট জাল করা। এক কথায় বাহাদুরেরা মুক্তি পেল, আটকা পড়ে গেল বীরেরা। দেশবাসী এসব বাহাদুরকে পছন্দ করে না। আশ্রয়হীন হাতীটিকে তারা বাহাদুর হিসেবে দেখেনি, দেখেছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে, বঙ্গবাহাদুর নাম যারা দিয়েছিলেন তারা হাতীটিকে সম্মান করেননি, অসম্মানই করেছেন; অনেকটা যেভাবে বীরাঙ্গনা নাম দিয়ে লাঞ্ছিত মেয়েদের সম্মান করা সম্ভব হয়নি, উল্টো তাদের জন্য বিড়ম্বনাই সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ বাহাদুরদের আর দেখতে চায় না, তাদের হাত থেকে মুক্তি পেলে বাঁচে। বাহাদুরেরা হেন অপরাধ নেই যা করে না, মেয়দের উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে জঙ্গি সেজে নিরীহ মানুষ হত্যা পর্যন্ত সর্বত্র তাদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

Recent Posts

Leave a Comment