বিবেক বিক্রেতা দলদাসেরা

 In খেলাধুলা
বিবেক বিক্রেতা দলদাসেরা

ভদ্র-স্বজন মানুষ হিসেবে তাকে চিনতাম-জানতাম। আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শের প্রতি তার আনুগত্যও অজানা নয়। দল-সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তার যোগাযোগ। আংশিক জানা থেকে ধারণা ছিল তিনি অন্ধ দলদাস নন। আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ, কেউই তাকে ধমক দিয়ে কোনো কাজ করাতে পারেন না। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তার একটা পরিচিতি এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল বলে মনে হতো। কারও কারও মুখে শুনেছি, প্রশাসনিকভাবেও তিনি দক্ষ মানুষ। বলছি ড. শামসুজ্জামান খানের কথা। বহু বছর ধরে শামসুজ্জামান খানকে নিয়ে এমন প্রচারণা শুনেছি। আর এখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে চিনছি-জানছি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিচয়ে। এতদিন যে শামসুজ্জামান খানকে জেনেছি, এখন জানছি তার উল্টো চরিত্রের শামসুজ্জামান খানকে। মাঝেমধ্যে প্রকাশকদের থেকে নানা কথা শুনেছি, বিশ্বাস করিনি বা করতে চাইনি। শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবীন আহসান যখন জানালেন, তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখলেন, সমালোচনা করায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্যে একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সত্যি বলছি, রবীনের এ কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না।

এ কথা সত্যি যে, দায়িত্বশীল পদে থাকলে অনেক সময় এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা হয়ত ইমেজের সঙ্গে মানানসই নয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে শামসুজ্জামান খানও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে বা আরও বড় কোনো স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা নিতে বাধ্য হয়েছেন। আমার বা অনেকের অপছন্দ হতে পারে, দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকতে পারে সে সব সিদ্ধান্ত বিষয়ে। সে সব কিছু বিবেচনায় রেখেই বলছি, শামসুজ্জামান খানের এতদিনের যে ইমেজ, তার যে ইমেজের সঙ্গে আমরা বা আমি পরিচিত ছিলাম, তার সামান্যতমও অবশিষ্ট থাকল না। পুরোটা ধ্বসে গেল। হয় মহাপরিচালক পদ তার রূপান্তর ঘটিয়েছে, অথবা এতদিন তাকে যে ইমেজে চিনতাম-জানতাম, আমাদের সেই চেনা-জানা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। এখন যে শামসুজ্জামান খানকে দেখছি, এটাই তার আসল ইমেজ বা অবস্থান বা পরিচিতি। যে পরিচিতি বা অবস্থানে নীতি- নৈতিকতার স্থান নেই। আছে দলের কাছে প্রাপ্তির আশায় আত্মসমর্পণ ।

২.

একটি বইকে কেন্দ্র করে গত বছর মেলায় একটি প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয়া হয়। বইটি নিষিদ্ধ হয়। আগেই বলেছি, দায়িত্বশীল পদে থাকলে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা হয়ত ব্যক্তির ইমেজের সঙ্গে মানানসই নয়। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যারা দ্বিমত পোষণ করেছেন, বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে তাদের অনেকে আবার এই সিদ্ধান্ত সমর্থনও করেছেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় বিতর্ক থাকা খুব স্বাভাবিক বিষয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অনেকে বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন, অনেকে প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদ যারা করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবীন আহসান। রবীনসহ অন্যান্যদের প্রতিবাদ এবং শামসুজ্জামান খানের সিদ্ধান্ত বিষয়ক কিছু বিশ্লেষণ-

ক. প্রকাশনী নিষিদ্ধ, বই নিষিদ্ধ, লেখক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রবীন আহসান মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন। বক্তৃতা করেছেন। টেলিভিশন টকশোতে কথা বলেছেন, নিজের মতামত তুলে ধরেছেন। রবীন আহসানের মতামত বা বক্তব্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে গেছে। তাতে সমস্যাটা কী হয়েছে?

খ. বাংলা একাডেমি কী এমন প্রতিষ্ঠান যে, তার সমালোচনা করা যাবে না? বাংলাদেশের কোনো আইন তো তাদের সেই সুরক্ষা দেয়নি। যদি সেই সুরক্ষা দিত,তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাও প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব হতো। বাংলা একাডেমির মাননীয় মহাপরিচালক আপনি নিজেকে কী ভাবছেন? আপনি একজন সম্মানিত মানুষ, এমন কোনো মহামানব বা অতিমানব বা ধর্ম প্রচারক নন যে, আপনার কোনো কাজের বা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা যাবে না। দেশ ও জাতির জন্যে আপনি যে দায়িত্ব পালন করছেন, তার জন্যে আপনি অর্থ এবং নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, নিচ্ছেন। যাদের অর্থে আপনি বেতন-ভাতা পান, তাদের মধ্যে রবীন আহসানও একজন। আপনার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার অধিকার রবীন আহসানদের আছে। বাংলাদেশের সংবিধান রবীন আহসানদের সেই অধিকার দিয়েছে। তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ আপনাকে দেয় নি।

গ. বাংলাদেশের প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী। এদেশে তারও সমালোচনা করা যায়, করা হয়। সেক্ষেত্রেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা জটিলতা বা সমস্যা হয়। তবে সমালোচনা করা যায়। সেখানে আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক। প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় আপনার গুরুত্ব খুবই সামান্য। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যেও রবীন আহসানরা প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর আপনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্লাকার্ড হাতে দাঁড়ানো যাবে না, মানববন্ধন করা যাবে না, টকশোতে কথা বলা যাবে না? ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে, নিজেকে আপনি সব কিছুর উর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন, আপনি কিন্তু তা নন।

ঘ. বড় জটিলতার আশঙ্কায় আপনি প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছেন। তা নিয়ে আপনার বড় সমালোচনা করছি না। বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে হয়ত আপনার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। তীব্র  দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও এ কথা বলছি।

একইভাবে একজন প্রকাশক হিসেবে আরেকজন প্রকাশকের পাশে দাঁড়ানোর অধিকার রবীন আহসানের আছে। সেই নৈতিক দায়িত্বই রবীন আহসান পালন করেছেন, কোনো অন্যায় করেননি। রবীন একজন প্রকাশক, তার চেয়ে বেশি অ্যাক্টিভিস্ট। ব্যবসার চেয়ে যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেন। এ কথা আপনার জানা থাকা দরকার ক্ষমতার পরিবর্তন বা অন্য কোনও কারণে আপনিও যদি কোনও বিপদে পড়েন, প্রথম মানববন্ধনের উদ্যোগ রবীন আহসানরাই নিবেন। আপনার চারপাশে এখন যারা আছে,তাদের কাউকে খুঁজে পাবেন না। রবীন আহসানের হাতে পেট্রোল বোমা বা চাপাতি থাকে না। থাকে প্লাকার্ড। রবীন ভাঙচুর বা জ্বালাও-পোড়াও করেননি, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করেছেন। করার আইনগত অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান রবীন আহসানদের দিয়েছে।

ঙ. মাননীয় মহাপরিচালক আপনি একটি বই মেলায় নিষিদ্ধ করে, স্টলটি বন্ধ না করে দিয়েও সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। তা করেননি। আপনি ভুলে গেছেন যে, ওই প্রকাশনী শুধুমাত্র একটি বই-ই প্রকাশ করেনি। আরও অনেক বই প্রকাশ করেছে। একটি বইয়ের জন্যে মেলায় প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত অপরিহার্য ছিল না। তারপরও আপনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এখন আপনি বলছেন প্রকাশনী বন্ধ করে না দিলে হেফাজত মেলা জ্বালিয়ে দিত! জানি না এ কথা আপনি বুঝে বলছেন কিনা? আপনার এই কথায় কারা আশকারা পাচ্ছে তাও আপনি বুঝতে পারছেন কিনা?

আসলে দলীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্য যখন পদপ্রাপ্তি বা চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, তখন আর নিজস্বতা বা বিবেচনাবোধ বলে কিছু থাকে না। ড. শামসুজ্জামান তা আবার প্রমাণ করলেন।

৩.

গত বছর যে সময়ে এই ঘটনা ঘটেছে, সেই সময়টা একবার স্মরণ করতে অনুরোধ করি। সেই সময়ে হেফাজত-জঙ্গি বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী ছিল?

জঙ্গিরা হত্যা করছিল ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে। তখন সরকারের অবস্থান ছিল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে মনে হতে পারে যে, সরকার নাস্তিকদের পক্ষ নিয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারকদের এমন ভাবনা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা তা লিখেছিলেনও। সরকারের এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিল শামসুজ্জামান খানের সিদ্ধান্তে। নিজস্ব বিচার-বিবেচনা-বিচক্ষণতার চেয়ে সরকারকে খুশি করা ছিল তার মূল লক্ষ্য। গত বছরের বইমেলায় তার আরও কিছু সিদ্ধান্ত তা প্রমাণ করছে।

এদেশের একুশের বইমেলার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপন। জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার দীপন হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারা দেশ তো বটেই, দেশের বাইরেও হইচই হয়েছে। দীপনকে হত্যা করা হয়েছে অক্টোবর মাসে। পরের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় বাংলা একাডেমি দীপনকে স্মরণ করেনি। দীপন স্মরণে মেলায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ‘দীপন স্মৃতি সংসদ’কে শামসুজ্জামান খান কথা দিয়েছিলেন মেলা চলাকালীন একটি স্মরণসভা আয়োজন করবেন। তিনি তার কথা রাখেননি। চাতুরতার সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রক্ষা করার প্রয়োজন মনে করেননি।

আগের বছর বইমেলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন লেখক অভিজিৎ রায়। তাকেও শামসুজ্জামান খান স্মরণ করেননি পুরো মেলার কোনো আয়োজনে। কারণ তিনি মনে করেছেন, সরকার হয়ত পছন্দ করবে না। নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য, বিবেচনাবোধ কাজে লাগাননি। দলীয় আনুগত্যের কাছে শর্তহীন নতীস্বীকার করেছেন। ড. শামসুজ্জামান খান আপনি চাপাতির কাছে আত্মসমর্পণ করে, প্লাকার্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আপনার সঙ্গে নাকি সংস্কৃতিমন্ত্রীও আছেন। সংস্কৃতির নামে কত বড় অপসংস্কৃত কাজ করছেন আপনারা!!

কে কত বড় লেখক, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে ভাবছেন। লেখক রতন তনু ঘোষের মরদেহ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেননি। রতন তনু নাকি বড় লেখক না। ক্ষমতার দাম্ভিকতা কাকে বলে!

লেখক গবেষক বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজে যাদের সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করার কথা, তারা নিজেদের বিবেক বিক্রি করে দিচ্ছেন। ‘চোখের মণি’ ‘হাতের কলম’ আলু পটলের মতো বিক্রি করে দিচ্ছেন। নিজেরা বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠান বলতে এদেশে আর কিছু অক্ষুণ্ন থাকছে না।

গোলাম মোর্তোজা
সম্পাদক, সাপ্তাহিক ।

Recent Posts

Leave a Comment