বাংলাদেশের গান গাইলেন জোয়ান বায়েজ

 In খেলাধুলা
মতিউর রহমান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালিকে নয়, সারা বিশ্বের সৃজনশীল মানুষকে টেনেছিল। এ রকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা—

জোয়ান বায়েজ এখন১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের জনগণের ওপর নৃশংস সশস্ত্র আক্রমণ চলছিল, তখন জোয়ান বায়েজ লিখেছিলেন ‘দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’ গান। এই গানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে। এভাবে; ‘ছাত্রাবাসে সন্ত্রাস/ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুন হচ্ছে সৈনিকের হাতে,/ নিদ্রামগ্ন ছাত্ররা তাদের বিছানায় সৈনিকের গুলিতে/ ভয়ার্ত চিৎকার, হিমঠান্ডা পরিবেশ, রক্তাপ্লুত বিছানা বালিশ।’
জোয়ান বায়েজের ‘দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’ গানটি পরে অ্যালবাম বা সিডিতে ‘সং অব বাংলাদেশ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সমর্থনে জোয়ান বায়েজের গান ‘দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’ আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। গানটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন জোয়ান বায়েজ নিজেই। গানটি গেয়েছেনও তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই জোয়ান বায়েজের ‘বাংলাদেশ’ গানটি প্রথম শোনার সেই অভিভূত মুহূর্তগুলোর কথা এখনো স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে আছে। সেই প্রথম শোনার পর এ পর্যন্ত চার দশক ধরে বহুবার শুনলেও এই অবিস্মরণীয় গানটি আজও পুরোনো হয়নি। এখনো এ গান একাত্তরের সেদিনগুলোতে টেনে নিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর শোনা গানগুলোর মধ্যে জোয়ান বায়েজের গানটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
জোয়ান বায়েজের গানটির প্রতি আমাদের একটা পক্ষপাত আছে। সে জন্য এক দশক ধরে গানটি বাংলায় রূপান্তর করে আমাদের নানা অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। এবং গানটি করেন আমাদের একজন প্রিয় শিল্পীবন্ধু মাহমুদুজ্জামান বাবু। আর, এই গান বাংলায় রূপান্তর করেছেন আমাদের সহকর্মী কবি সাজ্জাদ শরিফ।

১৯৬৩ সালের মার্চে ওয়াশিংটনে বব ডিলান ও জোয়ান বায়েজ l ছবি: সংগৃহীতপ্রতিবাদী শিল্পী জোয়ান বায়েজ শিল্পী বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসনদের সঙ্গে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ অংশ না নিলেও বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ তাঁর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। জোয়ান বায়েজ তাই লিখেছিলেন এক হৃদয়-নিংড়ানো সংগীতালেখ্য। গানের শুরুর কয়েকটি লাইন এ রকম: ‘বাংলাদেশ…পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যায়/ লক্ষ মানুষ নিহত হয় বাংলাদেশে/ আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখি;/ ক্রুশবিদ্ধ পরিবার, কিশোরী মাতার অসহায় শূন্য দৃষ্টি/ তার শিশু লড়াই করছে ঝড়-বৃষ্টি আর কলেরার সাথে’।…
জোয়ান বায়েজ ষাটের দশকের শুরু থেকেই একজন প্রতিবাদী শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকারের যে বৃহৎ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। একইভাবে দেশে ও বিদেশে মানবাধিকার, বন্দী মুক্তি এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। আমাদের মনে আছে, উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় শহরে যখন মার্কিনরা বোমাবর্ষণ করছিল, জোয়ান বায়েজ তখন সেখানে ছিলেন। শুধু ভিয়েতনাম নয়, তিনি লাওস, কম্বোডিয়া, ফিলিস্তিন, চিলি, আর্জেন্টিনা, তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বহু দেশে গেছেন, গান করেছেন, মিছিলে অংশ নিয়েছেন।
জোয়ান বায়েজ আজও সক্রিয় তাঁর গান নিয়ে। সম্প্রতি তাঁর ৭৫তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হয়েছে নিউইয়র্কের অ্যালবার্ট হলে এক অনুষ্ঠান করে। সেখানে নিজে যেমন গান করেছেন, তেমনি পুরোনো ও নতুন বন্ধুদের নিয়েও অনেক গান করেছেন।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বব ডিলানকে শ্রোতাদের সামনে জনপ্রিয় করতে অনেক সাহায্য করেছিলেন। একসঙ্গে অনেক গান করেছেন। ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে এক রোমান্টিক সম্পর্ক হয়েছিল। তারপরও তাঁরা একত্রে গান করেছেন অনুষ্ঠানে। বব ডিলানের তৈরি সিনেমায় অভিনয় করেছেন জোয়ান বায়েজ।

শ্রীনাথ রাঘভনের ১৯৭১: আ গ্লোবাল হিস্টরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ বই থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে জোয়ান বায়েজ স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ১২ হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে গানটি করেছিলেন। তারপর মিশিগান ইউনিভার্সিটির আরেকটি বড় কনসার্টে জোয়ান বায়েজ ‘দ্য সং ফর বাংলাদেশ’ গান গেয়েছিলেন। তাঁর এই গান ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মতো ব্যাপক প্রভাব তৈরি করতে না পারলেও সে সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাশাসকদের নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরতে পেরেছিলেন। এবং দেশে-বিদেশে এর প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। সে জন্যই জোয়ান বায়েজ এখনো আমাদের এত প্রিয়, শিল্পী হিসেবে একজন কাছের মানুষ।

জোয়ান বায়েজের গান

বাংলাদেশ

বাংলাদেশ

বাংলাদেশের কাহিনি

সে তো আইনপ্রসূত আদেশ পালনে সিদ্ধ

অন্ধদের হাতে

নতুন করে গড়া সেই প্রাচীন কাহিনি

যে আইনের ওপর নির্ভরশীল জাতিসমূহ

যে আইন মাতৃভূমির জন্য দাবি করে আত্মত্যাগ।

কোরাস

বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ

বাংলাদেশ

পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যায়

লক্ষ মানুষ নিহত হয় বাংলাদেশে

আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখি;

ক্রুশবিদ্ধ পরিবার, কিশোরী মাতার অসহায় শূন্য দৃষ্টি

তার শিশু লড়াই করছে ঝড়-বৃষ্টি আর কলেরার সাথে।

ছাত্রাবাসে সন্ত্রাস

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা খুন হচ্ছে সৈনিকের হাতে,

নিদ্রামগ্ন ছাত্ররা তাদের বিছানায় সৈনিকের গুলিতে

ভয়ার্ত চিৎকার, হিমঠান্ডা পরিবেশ, রক্তাপ্লুত বিছানা বালিশ।

কোরাস

বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ

বাংলাদেশ

ফৌজি অফিসারের রক্তদানের আহ্বান

কী অদ্ভুত শোনায়—স্বেচ্ছায় রক্তদান

ওরা অনেক করেছে, দিয়েছে শরীরের প্রতিটি রক্তকণা

আঘাত কিংবা রক্তপাতের বেদনাকে

গ্রাহ্য করেনি কখনো।

তাই তো বাংলাদেশের কাহিনি

সে তো আইনপ্রসূত আদেশ পালনে সিদ্ধ

অন্ধদের হাতে

নতুন করে গড়া সেই প্রাচীন কাহিনি

যে আইনের ওপর নির্ভরশীল জাতিসমূহ

যে আইন মাতৃভূমির জন্য দাবি করে আত্মত্যাগ।

অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ

Recent Posts

Leave a Comment