‘সুলতান সুলেমান’ থেকে শিক্ষা নিন : সাহেদ আলম

 In খোলা কলাম

‘সুলতান সুলেমান’ থেকে শিক্ষা নিন

ছোট বেলায় ‍হুমায়ূন আহমেদের গল্প অবলম্বনে নাটক ‘অয়োময়’ দেখতাম ঘটা করে। তখনকার সময়ে ইউটিউব এত কাছে আসেনি, অথবা যাত্রা শুরুই করেনি, তাই এক নিমিষেই সেগুলো দেখে ফেলার কোনো সুযোগ ছিল না। আমার দর্শক রুচির মধ্যে সেই বাল্যবেলার ভালো একটি সিরিয়াল ছিল সেটি। এরপর, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, বা হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’, অথবা ‘কোথাও কেউ নেই’- এগুলো দেখেছি আগ্রহ নিয়ে।

এনটিভি যাত্রা শুরু করার সময় মাসুম রেজার রচনায় সালাহউদ্দীন লাভলু’র পরিচালনায় নাটক ‘রঙের মানুষ’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যদিও এর নাট্যভাষা আর বালখিল্যতা নিয়ে সমালোচনা করতেন অনেকেই; কিন্তু দর্শক সেটিকে সানন্দে গ্রহণ করেছিল। এর পর কি আর সেইভাবে নাটক সিরিয়াল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে সেই অর্থে ব্যাপকভাবে? এখনকার দিনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং তার ব্রাদারদের নির্দেশনায় বেশ কিছু নাটক হয়েছে ভালো করে মনে রাখার মত; কিন্তু সেই নাটকীয় ট্রেন্ড এত বেশি অন্যেরা নকল করেছে যে এখন আর নাটক বা টিভি সিরিয়ালে কোনো নতুনত্ব নেই।

একজন হিন্দি সিরিয়ালবিরোধী দর্শক হিসেবে আমি অন্তত মনে করতে পারি না যে, সর্বশেষ বাংলাদেশি কোন সিরিয়াল বা মেগা ধারাবাহিকটি আমার নজর কেড়েছে। ‘সুলতান সুলেমান’-এর সর্ব  পর্ব আমি নিজে দেখেছি- এমন নয়। তবে শুনেছি, এর ভক্ত অনেক। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ-মহাদেশেও। স্বভাবতই বাংলাদেশের মানুষ এই সিরিয়ালটি গ্রহণ করেছে এর ইসলামি ইতিহাস, প্রাসাদ কাহিনি, নারীর মায়াযাদু, আর বিশেষত হুররমের অভিনয়।

নাটকের নাম সুলতান সুলেমান হলেও মূল আকর্ষণ বা কেন্দ্রীয় চরিত্র তো আসলেই এই নারী, যাকে দেখলে চোখের তৃপ্তি বাড়ে-সেটা বলা যায়। সেদিকে না বাড়িয়ে ‘সুলতান সুলেমান’-এ কেন ক্ষেপেছেন আমাদের নাট্যজন এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা? এসবের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে যে সামাজিক আলোচনা চলছে সেখানে আমি কিছুটা যোগ করতে চাই।

ফেডারেশন অফ টেলিভিশন প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন নামক একটি সংগঠনের উদ্যোগে এই আন্দোলনে ‘সুলতান সুলেমান’ শুধু বন্ধই না, বরং বিজয় দিবসের দিনে কেন এই সিরিয়াল চালিয়েছে দীপ্ত টিভি সেটি বিবেচনায় নিয়ে টিভি স্টেশনের সম্প্রচার বন্ধের দাবি তুলেছে আন্দোলনকারীরা। কী অবাক কাণ্ড রে বাবা! সেটি করতে হবে কেন, সেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তারা বলছেন, বিজয় দিবসের দিনে আমাদের সংস্কৃতির প্রতি অবমাননা করা হয়েছে। এত বড় আহাম্মক আর স্বৈরাচারী শিল্পীসমাজ কি আছে অন্য কোথাও?

সেখানে আরো একটি বক্তব্য দিয়েছেন সংগঠনটির আহবায়ক নাট্যজন মামুনুর রশীদ। ‘সুলতান সুলেমান’ বন্ধ করার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচারে তুরস্ক বাংলাদেশের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে। অথচ সেই দেশের সিরিয়াল আমাদের দেশে প্রচার হচ্ছে। এটি বন্ধের জোর দাবি জানাচ্ছি।’ (সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন)। এই নিয়ে গরম সোশ্যাল মিডিয়া।

আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে আমার বন্ধু তালিকায় থাকা মাসুম রেজার (রঙের মানুষের রচয়িতা) ফেসবুকের পোস্টে একজন মানুষ তাদের এসব প্রতিবাদ নিয়ে একটি কমেন্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘সুলতান সুলেমান’ বন্ধ করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম’’। আসলে সুলতান সুলেমান বন্ধ করা হলেও আপনাদের মানহীন একঘেঁয়েমি সিনেমা আর নাটকগুলো দর্শকরা দেখবে না। এই কথাটুকু বুঝতে এত বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়। টিআরপিও বাড়বে না একটুও।

আপনাদের আন্দোলনে বরং ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের মুনাফাই বৃদ্ধি হবে। আপনাদের শূন্য ঝুলি শূন্যই থেকে যাবে। তাই অর্থহীন আন্দোলন না করে বরং চলচ্চিত্রের মান নিয়ে চিন্তা করুন। কারণ কোয়ালিটির কারণেই ‘সুলতান সুলেমান’ সিরিজটি দর্শকরা দেখে। কিছু জোর করে খাওয়ালে তা হজম হয় না বরং বমি করে তা উগলে দেয়। এই কথাটুকু মনে রাখা উচিত।

আসলেই বেশির ভাগ মানুষের উপলব্ধি এমন। শিল্পীসমাজের এই আন্দোলন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, অনেক ক্ষোভ আছে। কেননা, শিল্পীসমাজ ভারতীয় টিভি সিরিয়াল বাংলাদেশে প্রদর্শনের বিরোধিতা করে না। গদগদভাবে ভারতীয় সব অনুষ্ঠানে যান এর হর্তাকর্তারা, সন্মাননা নেন, ‘তারা বাংলা’য় প্রোগ্রাম করেন। তারা  নিয়মিত ‘বোঝে না কেউ বোঝে না’ টাইপের সিরিয়াল দেখেন বাসায় বসে। স্টার জলসা আর জি বাংলার লোগো তাদের বাসার টিভি সেটে গেঁথে গেছে সেটা নিয়ে আন্দোলন নেই।

দেশের সকল শিল্পী আর বোদ্ধাসমাজ, এমনিক নির্মাতারা যখন এসব ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে প্রদর্শনের বিরুদ্ধে লাগাতার কথা বলেছেন তখন এই শিল্পীসমাজ যারা এখন মাঠে তাদের কাউকেই পাওয়া গেছে বলে মনে হয় না। এখন নিজেদের আন্দোলনে শিল্পী বাঁচাই, শিল্প বাঁচাও-এর দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে যেসব যুক্তি তারা আনছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই হাস্যকর এবং গায়ের জোর প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ বলেই মনে হচ্ছে।

তুরস্কের সিরিয়াল কেন বাংলাদেশে চলবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলছেন বিজয় দিবসের দিনে কেন এই নাটক দেখানো হবে টিভিতে। বিজয় শব্দের অর্থই হলো আনন্দ আর উদযাপন, এই আনন্দ আপনি কীভাবে করবেন সেটিও যখন নির্দেশনার মাধ্যমে আপনি নিয়ম-নীতি বেঁধে দিতে চান তখন সেই বিজয়ের অর্থই হয়ে যায় পরাধীনতা।

আমি নিজে সুলতান সুলেমান দেখি না। তবে সুলতান সুলেমান নিয়ে যেসব লঙ্কাকাণ্ড ঘটছে সেগুলোর প্রেক্ষিতেই এটি নিয়ে লেখার আগে অনলাইন ঘেঁটে এটি সম্পর্কে যেসব তথ্য জানলাম সেটা হলো; এটা ১২৯ পর্বে, ৪টি সিজন বা মৌসুমের একটি আরব্য রজনী টাইপের নাটক। যা এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক মহাদেশের দর্শকদের মন জয় করেছে। অটোমান সুলতানকে প্রেমের জালে আবদ্ধ করে হুররমের সাধারণ দাসী থেকে সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠার গল্প এটি। যার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী সুলেমানের প্রথম স্ত্রী মাহিদেভ্রাণ সুলতানা, সুলেমানের মা আয়েশা হাফসা সুলতানা, সুলতানের বাল্যবন্ধু এবং পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের প্রধান উজির ইব্রাহীম পাশা।

প্রায় ৭০০ বছর ধরে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল পৃথিবীজুড়ে। এ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। ক্ষমতার টানাপোড়ন অটোমান সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই হত্যা, সন্তান হত্যা এবং দাসপ্রথার অন্তরালের কাহিনি নিয়ে নির্মিত এ মেগা সিরিয়ালের প্রথম মৌসুমটি প্রচার করছে মাত্র বাংলাদেশের একটি চ্যানেল। এখনো এটির তিনটি মৌসুম বাকি।

অর্থাৎ সাম্রাজ্যের পতন আর তার পরিপ্রেক্ষিতগুলো এখনো জানা হয়নি। তার আগেই এটির দর্শক প্রিয়তা আর তার ওপর ভর করে বিজ্ঞাপনের বাজার লুফে নিয়েছে চ্যানেলটি। তাতেই ক্ষেপেছেন শিল্পীসমাজ। তাদের দেখাদেখি আরো কয়েকটি চ্যানেল বিদেশি সিরিয়াল ডাবিং করে প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং মূল নাটক দেখার সময় অর্থাৎ প্রাইম টাইমে সেগুলো প্রচার না করায় তাদের নাটক যেগুলোকে বস্তাপচা হিসেবেই দেখেন অধিকাংশ দর্শক, সেগুলো নাকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!

তাদের দাবিকে একেবারেই অযৌক্তিক বলা যাবে না। তবে এটা তো ঠিক, দর্শক কী দেখবে আর কী দেখবে না সেটা তো আপনারা নির্ধারণ করে দিতে পারেন না। নাটক এবং নাটক চর্চাকে যে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে সেখান থেকে বরং পরিত্রাণের উপায় বের করাটাই জরুরি, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে কি?

পরিত্রাণের উপায় বলছি এই কারণে যে, এর মাধ্যমে আপনারা যারা শিল্প তৈরি করেন এবং নাট্যতত্ব নিয়ে গবেষণা করেন তাদের দর্শকের রুচিবোধ সম্পর্কে জানার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। টেলিভিশন আর বিটিভি যুগে নেই যে যা খাওয়ানো হবে সেটাই খাবেন দর্শকরা। বিটিভির সময়ে সেই সুযোগ ছিল ১০০ ভাগ। তবুও সেই সময় বিটিভি কর্তৃপক্ষ ‘আলিফ লায়লা’ শিরোনামের অদ্ভুত বাজে নির্মাণের সেই ভারতীয় সিরিয়াল দেখিয়েছে, সেটা দেখেছিলও দর্শক।

এর পরে সম্রাট আকবরের শাসনামল নিয়ে ‘আকবর দ্যা গ্রেট’ শিরোনামের দীর্ঘ লম্বা সিরিয়াল উপভোগ করেছে। শিল্প বা নাটক নির্মাণের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় আমাদের দর্শকরা উঁকি দিয়ে বিশ্ব সংস্কৃতি আর কৃষ্টিকে জানার চেষ্টা করেছে। আমরা ছোটবেলায় ‘ম্যাকগাইভার’ দেখতাম, এর পরে ‘এক্স ফাইল’ নামের সিরিজ দেখেছি। কত জনের মনের মধ্যে সে সময় ম্যাকগাইভার চরিত্র গেঁথে গেছে তার হিসাব নেই।

সে সময়ের ছেলেমেয়েদের অনেকেই ভিতরে ভিতরে আইনস্টাইন হওয়ার স্বপ্ন দেখতো, আমি আমার নিজেকে দিয়েই সেটি বলছি। এর সবই হয়েছে বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে মেল বন্ধনের কারণেই। কই এর পরও তো  ভালো ভালো নাটক তৈরি হয়েছে দেশে, দেশীয় নাটক আর শিল্পীরা না খেয়ে মারা যায়নি। সেখান থেকে আপনারা কোনো কিছু শেখেননি এটা সত্য।

আপনারা শিখেছেন স্টার জলসার পারিবারিক কলহ আর হিংসা বিদ্বেষ ছড়ানোর সিরিয়াল নকল করার শিক্ষা। ‘গুলশান এভিনিউ’ বা অন্য কয়েকটি নাটক আপনারা ভারতীয় আদলে নির্মাণ করতে চেয়েছেন, যেটার মধ্যে আমাদের নিজস্ব কোনো সংস্কৃতি ছিল না, ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি।

এই সব নাটকে ছয়লাব প্রতিটি চ্যানেল। একটিও দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। কেননা, আপনারা একপর্বে যেই কাহিনি প্রচার করা যায় সেটিকে টানতে টানতে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন প্রতি পর্বের পয়সা পাওয়ার জন্য যে তার নাট্যতত্ব রক্ষা করার দিকে কারোর-ই খেয়াল ছিল না। ছিল না বলেই আজকে মনোজগতে ‘সুলতান সুলেমান’ কিংবা ‘বোঝে না সে বোঝে না’ জাতীয় সিরিয়ালের প্রভাব।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে আপনারা শাশ্বত বা সত্য সংবাদ প্রবাহে ঘুণ ধরিয়েছেন। চেতনার কথা বলছেন সেটি ঠিক আছে, কিন্তু আপনারা অগণতান্ত্রিক সরকার, আচরণকে প্রকাশ্যেই সহায়তা করছেন নানানরকম আন্দোলন আর মাঠের উপস্থিতি দিয়ে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নাম প্রায় এখন বলা চলে ‘আনজুমান মফিদুল ইসলামে’র কাতারে। নিজেদের রাজৈনতিক ঘরানার ব্যক্তিবর্গের মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা জানানো আর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারের স্বার্থ রক্ষা করা ছাড়া বাদবাকি সকল অনাচারে নীরব থাকে সংগঠনটি।

রামপালবিরোধী আন্দোলন, সাঁওতাল গ্রামের বর্বরতা বা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাতের প্রতিবাদ করার সময় আপনাদের রাস্তায় পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় নির্বাচনের পর কোথায় বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা হিন্দু নির্যাতন করেছে সেই প্রতিবাদে। এমন ভাঁড়ামো আর অতি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আনজুমান মফিদুল ইসলাম টাইপের সংগঠনে পরিণত হয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।

এখন টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বটিক খাওয়ানোর কথা বলছেন নাটকের প্রচার-প্রচারণায়। সেটি নিয়ে কোন বিরোধিতা নেই, কিন্তু ঐ যে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। মুক্তি চেতনার খেসারতে গণতন্ত্র হত্যা করার সংবাদ আড়াল হয়ে যায়, এখন তুর্কি সিরিয়াল বন্ধের জন্য মুক্তিচেতনার বটিকা নিয়ে হাজির কতিপয় সুধীজন। এই সুধীজনদের প্রধান যখন দেশীয় নাটক চর্চার বাইরে ‘‘চে’র সাইকেল’’ নাটকের নির্দেশক হন, তখন মনে হয় না এটি বিদেশি কোনো নাম বা বিদেশি কোনো চরিত্রের বাংলায়ন!

এই শিল্পীসমাজের নেতা নাট্যকার মামুনুর রশীদ সেই ব্যক্তি যিনি এটিএন বাংলায় প্রচারিত ‘বিনোদন জুমাবার’ টাইপের নাটকের প্রধান পরামর্শক। মাহফুজুর রহমান নিজে দাবি করতেন তার এই নাটকের জন্য নাকি দেশে বোরকার প্রচলন বেড়েছে। আমাদের মনে পড়ে, মাছরাঙার সহকর্মী সাগর ভাই আর এটিএন-এর মেহেরুন রুনী দম্পতি যখন খুন হন তখন এই চ্যানেলের প্রধান বলা চলে প্রকাশ্যেই সাগর-রুনি দম্পতির বিরুদ্ধে চরিত্র হনন করে বক্তব্য দিয়েছিলেন।

মনে আছে সাংবাদিক সমাজ তখন বিভক্ত হয়ে যায় এটিএন বাংলার বিরুদ্ধে। সেসময় মাহফুজুর রহমানের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ।এই নিয়ে তখন ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। মাছরাঙায় সেই রিপোর্টটি আমি-ই করেছিলাম। তার প্রতি অসন্তোষ থেকেই এই লেখা লিখছি এমনটি নয়।

বিষয় হলো বন্ধ করে কোনো কিছুর সমাধান আসেনি, সেটা তারা বুঝলে লাভ সবার। কেননা, মামুনুর রশীদের মতো ব্যক্তিত্বরা খুব কম জন্মায়। তার নিদের্শিত নাটক ‘রাঢ়াঙ’ দেখেছি কয়েকবার মঞ্চে গিয়ে। অসাধারণ নাটক। তার মত মানুষেরা এবং তাদের অনুসারীরা যদি এখন বাংলাদেশের বস্তাপচা টিভি সিরিয়াল বানান শুধু মুনাফার জন্য তাহলে দর্শকদের নেহায়েত বঞ্চিত করা হবে।

যতদূর জেনেছি দীপ্ত টিভির ব্যবসায়িক দিকটি দেখে থাকেন ভারতীয় কিছু প্রচারমাধ্যম কর্মী। তারা নিশ্চয়ই দর্শক জরিপ বলে কিছু বিশ্বাস করেন। যেহেতু ভারতীয় সিরিয়ালগুলো শুধু সেদেশের নয়, বাংলাদেশের এমনকি আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও ব্যবসা করছে শুধু দশর্কপ্রিয়তার কারণে। তাদের কাছ থেকে যদি এমন কিছু শেখা যায় তাহলে আরো অন্তত ১/২ যুগ কিছু করে খেতে পারবেন আমাদের নির্মাতারা।

তাদের থেকে শেখা যায়, কেন মনে করছি, কারণ হলো আমাদের নাট্যতত্ত্ব নামক কিছু পড়াশোনার ক্ষেত্র আছে ঢাকা, জাহাঙ্গীর নগরসহ বেশক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু জরিপ, দর্শক মন বোঝার মত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা নেই। নেই গবেষণা। এখন যেহেতু সুলেমান সাহেব এসে দরোজায় কড়া নেড়ে গেছেন তাই প্রতিটি নাটক এখন থেকে সুলেমানী কায়দায় হতে হবে এমন কোনো কারণ নেই। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কিছু করার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

বলছি একারণে যে, আমাদের বিটিভির সংবাদ পানসে হয়ে যায় একুশে টিভির কারণে। এরপর অগণন একই ছাঁচে একুশে টিভি হয়েছে এবং মানুষের বিরক্তি বেড়েছে। অনেক একুশে টিভি এখন আবার বিটিভির ধারণায় ফিরে গেছে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই যে একুশে টিভির শিক্ষা, সেখান থেকেই সংবাদে ভিন্নতা এসেছে সিএসবি, সময়টিভি, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর, যমুনা টিভি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির মাধ্যমে।

নতুন কিছু করার চেষ্টা করে নিদেনপক্ষে তারা সমীক্ষা বা বোঝাপড়া করার সুযোগ পেয়েছে। একুশে টিভি সেসময় না আসলে আজকের এই সংবাদ ভিক্তিক চ্যানেল এর স্বপ্ন দেখতে পারতো না উদ্যোক্তারা। কেননা, দর্শক রুচি জানার আর কোনো মাধ্যম ছিল না। সুলতান সুলেমান যে রুটি রুজির উপর হামলা করছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে ‘সুলতান-তারেক’ বা ‘সুলতান-জয়’ নির্মাণ করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দেবেন বলে প্রত্যাশা করছি।

নিউইয়র্ক ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

সাহেদ আলম : সাংবাদিক।
shahedalam1@gmail.com

Recent Posts

Leave a Comment