ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর : শাইখ সিরাজ

 In খোলা কলাম
সরকার নতুন একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এক জেলা এক পণ্য। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির এ দেশের একেকটি এলাকায় রয়েছে একেক ধরনের ঐতিহ্য। আমরা বিচ্ছিন্নভাবে এ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলো দেখি। কিন্তু এগুলোকে বিশেষভাবে দেশবাসীর সামনে তুলে না ধরার কারণে ঐতিহ্যগুলোকে গভীরভাবে হৃদয়ে উপলব্ধি করি না। এ কারণেই এই ‘এক জেলা এক পণ্য’ কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কার্যক্রমের স্বপ্নদ্রষ্টা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তাগিদেই গত বছর চাঁদপুরেই এ কার্যক্রমের ওপর একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আমার জন্য অত্যন্ত আশার কথা, এ কার্যক্রমের সূচনা ঘটছে আমার জন্মভূমি চাঁদপুর জেলাকে নিয়ে। তার মানে চাঁদপুর জেলা এ ব্যাপারে অগ্রসর হয়েছে। তারা গুছিয়ে এনেছে তাদের সবকিছু। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার-২-এ এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হবে চাঁদপুর জেলার স্বাতন্ত্র্য পরিচয়। চাঁদপুর জেলার জন্য এই আয়োজনের নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’। এই শিরোনামটিও আমার যারপরনাই পছন্দ হয়েছে। আমি এই আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে ধন্যবাদ জানাই চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক আবদুস সবুর মণ্ডলকে। তিনি বেশ আন্তরিক ও কর্মচঞ্চল এক মানুষ। তার কর্মস্থল চাঁদপুর জেলার গুরুত্ব উপলব্ধি করেই তিনি এখানকার নিজস্ব পরিচিতি জাতির সামনে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন। গত কয়েকদিন আগে তিনিই আমাকে বিষয়টি জানালেন। নিজের জেলা বলে কথা। তার ওপর বাল্যবেলা থেকে ইলিশের প্রাচুর্য, স্বাদ আর ইলিশকেন্দ্রিক সংস্কৃতির স্পর্শে বড় হয়েছি। ছোটবেলা থেকে আমাদের বসতি ঢাকার খিলগাঁওয়ে হলেও জন্মভূমির টানেই বারবার চাঁদপুরে গিয়েছি। বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি সব সময়, কিন্তু সাংবাদিকতার প্রয়োজনে ইলিশ নিয়ে মেতে থেকেছি। জেলা প্রশাসক আমাকে বললেন, আমি যেন ইলিশ নিয়ে কিছু একটা প্রদর্শন করি ওই আয়োজনে। হাজারো ব্যস্ততা, সময়ও একেবারে কম। ইলিশ নিয়ে এই সময়ের মধ্যে কী করা যায়। আমার যা কাজ। একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণেরই উদ্যোগ নিলাম। ইলিশের নানা চিন্তা মাথায় নিয়েই ছুটলাম চাঁদপুর।
২৩ জানুয়ারি সকাল সাতটা বিশে সদরঘাট থেকে চাপলাম লঞ্চে। চাঁদপুরে গিয়ে পৌঁছলাম সকাল সোয়া ন’টায়। সেখান থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা জাহাজ এমভি রূপালী ইলিশে ওঠে ছুটলাম ডাকাতিয়া নদী হয়ে মেঘনার বুকে। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমানের সঙ্গে আগেই কথা হয়েছিল। তিনিই সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিলেন। সঙ্গে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের চাঁদপুর স্টেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাসুদ হোসেন খানও ছিলেন। ইলিশ নিয়ে কয়েক বছর আগেও আমাদের অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। সেই অবস্থাটি এখন নেই। গত কয়েক বছরে ইলিশের প্রাচুর্য আশাব্যঞ্জক হারে বেড়েছে। এখন ইলিশের ভরা মৌসুমে খোদ রাজধানীতেই ঝাঁকাভর্তি ইলিশ ফেরি করে বিক্রি হয়। অমৌসুমেও বিক্রি হয়। বাজারে ইলিশ সহজপ্রাপ্য। মেঘনা নদীর বুকে ঘুরছি, দুয়েকটি জেলে নৌকার দেখা মিলছে। আমরা উপস্থিত হলাম জাটকা ইলিশের অন্যতম একটি প্রজনন ক্ষেত্রে। চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার, মেঘনা নদীর নিু অববাহিকার ১০০ কিমি. এলাকা ইলিশের পাঁচটি অভয়াশ্রমের একটি। বিজ্ঞানীরা বললেন, নদীর পানিতে ইলিশের প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য উপকরণ থাকলেও নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোথাও কোথাও চরের আকার বেশ বড়।
এসব তথ্য নিয়ে আলোচনা করতে করতেই একটি জেলে নৌকার কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা। তখন বড় জাল টানা হচ্ছে। জাহাজ থামিয়ে জেলে নৌকায় উঠে বসলাম। খুব আশা করে জেলের জালের দিকে তাকিয়ে আছি। ইচ্ছে করল নিজ হাতেই একটু জাল টেনে দেখি। কিছুক্ষণ টানতেই অনুভব করলাম নড়ছে মাছ। নিমিষেই চোখে পড়ল চকচকে ইলিশ। মাঝ দুপুরে সূর্যের আলো পড়ছে জলের নিচের প্রান্তে, মাঝারি সাইজের কয়েকটি ইলিশ ওই আলোতে ঝলমল করছে। জেলেরা ইলিশ ছাড়িয়ে একটি আমার হাতে দিলেন। দু’হাত দিয়ে ধরেছি একেবারে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত ইলিশ। ছটফট করছে, হাত থেকে যেন লাফ দিয়ে পড়বে আবার নদীর পানিতে। জানতাম, সূর্যের আলো ইলিশের জন্য প্রাণঘাতী। সূর্যের আলো চোখে পড়লে ইলিশ আর বাঁচে না। কিন্তু অনেকক্ষণ হাতে ধরে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করলাম, ইলিশ তখনও নড়ছে। ড. আনিসুর রহমান বললেন, সামগ্রিকভাবে ইলিশের প্রাচুর্য বাড়ার পেছনে বড় কারণ মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধের কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন হওয়া। কয়েকটি মৌসুম কার্যকরভাবে সুরক্ষিত হওয়ায় ইলিশ সম্পদ নিয়ে আমাদের হতাশা কেটে গেছে। অন্যান্য বছর এই সময়ে অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ইলিশের দেখা পাওয়া যায় না, কিন্তু এবার আমরা লক্ষ্য করছি ইলিশের একটি স্বল্প মৌসুম (Minor Season) বেরিয়ে এসেছে। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক দিক। তিনি বললেন, এবারই প্রথম ১১ দিনের স্থলে ১৫ দিন ছাড়িয়ে ২২ দিনব্যাপী লম্বা সময় পাওয়ায় ইলিশ পেটে ডিম নিয়ে সাগর থেকে উপকূল-মোহনা বেয়ে মেঘনা-পদ্মা অতিক্রম করে মহানন্দা, যমুনা নদীতে এমনকি হাকালুকি হাওর পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে। এই সময়ব্যাপী ৪৩.৯৫ ভাগ ডিম ছাড়ার হার হিসাবে এ বছর ৩৯-৪১ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ জনতায় যুক্ত হয়েছে। এদের বড় হওয়ার সুযোগ দিলে ও যথাযথ সংরক্ষণ ব্যবস্থা করলে এবং জাটকা অভয়াশ্রম কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হলে বর্ধিত হারে ইলিশের উৎপাদন পাওয়া সহজ হবে।
দেখলাম মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ইলিশ নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে আধুনিক কিছু গবেষণা উপকরণ জোগাড় করেছে। এই উপকরণ নিয়ে নদীতে ইলিশের খাদ্য, পানির উপাদান, কার্বন-ডাই অক্সাইড ও অ্যামোনিয়া পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমরাও কিছুক্ষণ তাদের স্পিডবোটে এসবের সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখলাম। তারা বললেন, পরিস্থিতি যথেষ্টই অনুকূল। আমার মনে পড়ল, বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যা হয়ে ধলেশ্বরীর পথ দিয়ে মেঘনায় ওঠা পর্যন্ত ভয়াবহ কালো পানি আর দুর্গন্ধের যে বিভীষিকা, তা মেঘনার পানিতেও মিশছে। আমরা বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যাকে ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা করতে না পারলে না জানি কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গা থেকে ধলেশ্বরীতে নোংরা পানি ঢুকে গেছে। মুন্সীগঞ্জের যেসব এলাকায় ইলিশ পাওয়া যেত, এখন আর সেখানে ইলিশের দেখা মিলছে না।
নদী ঘুরে চাঁদপুরের বিখ্যাত ইলিশ ঘাটে উঠলাম। ঘাটে তখন সকালের বেচাকেনা শেষ, অনেকটা অলস সময়। অবাক হলাম ব্যবসায়ীদের ঝুড়িতে দেড়-দুই কেজি আকারের ইলিশের পসরা দেখে। জানলাম, এগুলো ঠিক এখনকার নয়, কিছু আগের। অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানালেন, ইলিশের প্রাচুর্য আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এখন চাঁদপুরের বা মেঘনার সুস্বাদু ইলিশ আর দুষ্প্রাপ্য নয়। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের জাহাজে ফিরে কিছুক্ষণ আগে ধরা ইলিশ কেটে ভাজার আয়োজন করা হল। তখনই স্বাদ পরখ করেও দেখলাম। হ্যাঁ, সেই হারানো স্বাদ। ছোটবেলায় স্কুল ফাইনাল দিয়ে বাবার সঙ্গে গ্রামে যেতাম। প্রাচ্যের সিংহদ্বারখ্যাত চাঁদপুর নদীবন্দরে পৌঁছতাম। বিশাল লঞ্চঘাট। চারদিকে ইলিশ আর ইলিশ। যদিও সেই ঘাট আর নেই। অব্যবস্থা আর অনিয়মে সব ঐতিহ্য যেন ম্লান হয়ে গেছে। আমার মনে আছে, আমি একবার একা ফিরছিলাম চাঁদপুর থেকে। নানাবাড়ির পাশে রাজাপুর বাজারে টাকায় এক গণ্ডা ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল। আমি এক ঝুড়ি ইলিশ কিনে এনেছিলাম। দরদাম করে টাকায় পাঁচটি পেয়েছিলাম। ইলিশ কেটে লবণ দিয়ে প্রক্রিয়া করে দিয়েছিল বিক্রেতারা। তারপর বহুবার গিয়েছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান করার সময় মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে বারবার গিয়েছি। আজকের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহ্হিয়া, ড. মাসুদ, ড. আনিস তখন তরুণ বিজ্ঞানী। তাদের সঙ্গে কত স্মৃতি। আবার গত দশ-পনেরো বছরেও আমার বর্তমান অনুষ্ঠান হৃদয়ে মাটি ও মানুষের জন্যও বারবার চাঁদপুরে যাওয়া হয়েছে। মেঘনা পারের জেলেদের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরেছি। জাটকা ও মা ইলিশ ধরা বন্ধের মৌসুমে জেলেদের দুর্দিনে তাদের অনিশ্চিত দিনাতিপাত দেখেছি। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বঙ্গোপসাগরের জেলেদের সঙ্গে ইলিশ সম্পদ নিয়ে বারবার কথা হয়েছে। ইলিশের প্রাচুর্য যেমন দেখেছি, মাঝে মাঝে হতাশও হতে হয়েছে সাগরে ও নদীতে ইলিশের আকাল দেখে। এই তো কয়েকদিন আগে পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে একটি জেলে নৌকায় উঠে জাল টানা দেখছিলাম। দীর্ঘ অপেক্ষা করে ইলিশ তো দূরের কথা একটি মাছেরও দেখা পেলাম না। জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রে লবণাক্ততার হার বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, কারেন্টজালসহ ছোট ম্যাশ সাইজের বিভিন্ন জাল দিয়ে মৎস্য আহরণের কারণে ইলিশ নয় শুধু, সব মাছের জন্যই পরিবেশ বৈরী হয়ে উঠছে।
আমি গভীরভাবে চাই, ইলিশের ঐতিহ্য ও প্রাচুর্য আরও বাড়ুক। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে আরও বড় জায়গা দখল করুক ইলিশ। আর এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে যা প্রয়োজন তা হল : ক. ইলিশ নিয়ে গবেষণা ও এ সংক্রান্ত উন্নয়নের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি ‘ইলিশ গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। গবেষণার আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণের জোগান নিশ্চিত করা। খ. নদী ও সমুদ্রের ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্রগুলোতে আরও কার্যকর জরিপ প্রয়োজন। যার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে আমাদের ইলিশ ক্ষেত্রের প্রকৃত অবস্থাটি কী? পরিস্থিতির পরিবর্তনগুলোও গভীর পর্যবেক্ষণে আনতে হবে। গ. নদী ও সমুদ্রের মাছসহ সব ধরনের জলজ প্রাণী ধ্বংসকারী কারেন্টজাল, বেড় জাল, চারঘেরা জাল ও বেহুন্দি জালের উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা। উল্লেখ্য, এখনও অবলীলায় এসব ধ্বংসাত্মক জাল তৈরি করছে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। তারা প্রচ্ছন্নভাবে প্রশাসনসহ প্রভাবশালীদের সহযোগিতাও পাচ্ছে। এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঘ. মাছের পাঁচটি অভয়াশ্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঙ. মাওয়া-গোয়ালন্দ-রাজবাড়ীতে জরুরি ভিত্তিতে আরেকটি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চ. ইলিশ চলাচলের পথগুলো নিরূপণ করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ইলিশের বাড়ি ও প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্রগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারলে ইলিশ নিয়ে আমাদের গর্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। আমরা হারাব বাঙালির স্বাদ ও তৃপ্তির এক বড় আধার।
শাইখ সিরাজ : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
Recent Posts

Leave a Comment