দাম কমালেও মুনাফা থাকবে ১৮৫৫ কোটি টাকা

 In লিড নিউজ
  • জ্বালানি তেলের দাম প্রকার ভেদে ৫ থেকে ৮ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের গড় মূল্য ব্যারেল প্রতি ৫৫ ডলার। চলতি বছর তা ৬০ মার্কিন ডলারে বাড়লেও মুনাফা থাকবে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। বিশেষ করে ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৮ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, এতে লাভের অংকে কোনো হেরফের হবে না। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে, ভর্তুকি কমবে। কৃষকরাও সুফল পাবেন।

    অর্থ সচিব স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে হিসাব কষে বলা হয়েছে, ডিজেল ও কেরোসিনে লিটার প্রতি ৮ শতাংশ দাম কমালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) লাভ থাকবে ১ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এছাড়া অকটেন ও পেট্রলের দাম ৫ শতাংশ কমালে মুনাফা থাকবে ২৪১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ ৪টি জ্বালানি পণ্যে বছরে বিপিসির লাভ থাকবে ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। চলতি বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ৬০ ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে- এমন ভিত্তি ধরেই মূল্য সমন্বয় পর্যালোচনা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি তা অনুমোদনের জন্য সার-সংক্ষেপ আকারে পাঠানো হয়েছে অর্থমন্ত্রীর কাছে। সংশ্লিষ্ট

    সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য। জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি ডিজেল এবং কেরোসিনের মূল্য কমানো হলে ভালো হবে। কারণ এগুলো পরিবহন, শিল্পে ব্যবহার বেশি হয়। এতে সাধারণ মানুষ কিছু সুবিধা পাবেন। তবে অকটেন ও পেট্রলের দাম কমানোর পক্ষে আমি নই। কারণ এর সুবিধা বেশিরভাগ পাচ্ছে ধনী শ্রেণীর মানুষ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ তেল উৎপাদন করে না। পুরোটা আমদানি নির্ভর। ফলে মূল্য সমন্বয় ও হ্রাস করার ব্যাপারে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

    এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল নিয়ে সরকার মুনাফা ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করতে চায়। সরকারকে প্রথমে নিজের পলিসি ঠিক করতে হবে। যদি মুনাফা ভিত্তিক পলিসি থাকে তাহলে বর্তমান যা করছে তাই হবে। তিনি বলেন, সরাসরি দাম কমিয়ে জনগণের কোনো উপকারে না আসে নানা উপায়ে তা করতে পারে সরকার। মূল্য হ্রাসের সুবিধা জনগণের হাতে পৌঁছে দিতে পারলে ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে, উৎপাদিত পণ্যের ব্যয় কমবে এবং সেখানে ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে সমন্বয় হবে। গোটা জিনিস এভাবে না দেখে কোনো বিশেষ জ্বালানির মূল্য কমানো বা বাড়ানো হলে এতে মানুষ কমালেও সুবিধা পায় না এবং বাড়ালে দুর্ভোগ বাড়েই।

    অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জেট-এ-১, প্রতি লিটার ৫৬.০৮ টাকা, ডিজেল ৫৯.৬৪ টাকা এবং ফার্নেস অয়েল ৪৪.৬৬ টাকায় আমদানি করেছে। বর্তমান সরকারের নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী প্রতি লিটার অকটেন ৮৯ টাকা, কেরোসিন ৬৫ টাকা, জেট-১-এ ৬৩ টাকা, ডিজেল ৬৫ টাকা, পেট্রল ৮৬ টাকা ও ফার্নেস অয়েল বিক্রি করছে ৪২ টাকা। এক্ষেত্রে কেরোসিন ও ডিজেলে ৮ শতাংশ এবং পেট্রলে ৫ শতাংশ মূল্য হ্রাস করা হলেও বছর শেষে সরকারের মুনাফা থাকবে। সে ক্ষেত্রে অকটেনে মুনাফা থাকবে ৬.০৯ টাকা, কেরোসিনে থাকবে ১০.৫৬ টাকা, জেট-এ-১ থাকবে ৬.৯২ টাকা, ডিজেলে ৩.২২ টাকা পেট্রলে ৫.০৮ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে ২.৬৪ টাকা।

    প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের ভেতরের তেলের মূল্য সমন্বয় করা হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর সুফল পৌঁছবে সাধারণ জনগণের কাছে। ইতিপূর্বে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়েছে। দাম কমানোর পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৫৫ থেকে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, রফতানি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩৯ থেকে ৯.৭৭ শতাংশ, মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পেয়ে ৭ থেকে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ হয়েছে। পুনরায় তেলের মূল্য কমানো হলে উল্লিখিত খাতসহ অর্থনীতির অন্য খাতগুলো সুফল পাবে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

    অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফার্নেস অয়েলের দামের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সরাসরি লেনদেনের সম্পর্ক নেই। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এর ব্যবহার থাকায় বিদ্যুতের দাম কম-বেশি বিষয়টি জড়িত। আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ৪৪ দশমিক ৬৬ টাকা। ইআরএল কস্ট বিবেচনায় প্রকৃত মূল্য হচ্ছে ৩৯ দশমিক ৩৬ টাকা। ইতিপূর্বে ৩০ শতাংশ মূল্য কমানোর ফলে এর সুফল ভোগ শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও হ্রাস পেয়েছে। মূল্য কমানোর পরও বর্তমানে প্রতি লিটারে সরকারের মুনাফা হচ্ছে ২ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

    সূত্র মতে, বর্তমান মোট চাহিদার ৮৬ শতাংশ পূরণ করছে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল এবং কেরোসিন। এর মধ্যে ডিজেল ৬৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল ১৭ শতাংশ এবং কেরোসিন ব্যবহার হচ্ছে ৫ শতাংশ। পাশাপাশি ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশই যাচ্ছে পরিবহন খাতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছে ২৬ শতাংশ, কৃষিতে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এসব খাতে মোট আমদানির ৪১ লাখ টন জ্বালানি তেল ব্যবহার হচ্ছে।

    অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব খাতের সঙ্গে সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন জড়িত। এদের মধ্যে অনেকে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী। এক্ষেত্রে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য হ্রাস করা হলে এসব জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ উপকৃত হবেন। এছাড়া বিদ্যুৎ খাত বিশেষ করে ইন্ডিপেন্ডেট পাওয়ার প্রোডাক্ট, রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে ডিজেল ব্যবহার হচ্ছে। ফার্নেসের মতো ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। ফলে ডিজেলের দাম কমলেও উৎপাদন ব্যয় ও সরকারের দেয়া ভর্তুকি কমবে। সুফল পাবেন কৃষিতে ডিজেল চালিত পাম্প ব্যবহারকারী কৃষক। এ বিবেচনায় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮ শতাংশ কমানো যেতে পারে।

    প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক পূর্ভাবাস দিয়ে বলা হয়, বিগত ৩ বছরে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও ২০১৭ সালে কিছুটা স্থিতিশীল থাকবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি তেল বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রতি ব্যারেল ৫৮ মার্কিন ডলারে। সেখানে বলা হয়, সব মিলে ৫৮ থেকে ৬০ মার্কিন ডলারে প্রতি ব্যারেল দাম ওঠা-নামার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই হিসাবে বর্তমান আমদানিকৃত মূল্য থেকে ডিজেল ও কেরোসিনে ৮ শতাংশ এবং পেট্রল ও অকটেনে ৫ শতাংশ হ্রাস করলেও সরকারের মুনাফা থাকবে।

    জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক মূল্য হ্রাসের ফলে ইতিপূর্বে সরকার এক দফা মূল্য কমিয়েছে। চলতি মাসে আরেক দফা দাম কমানো হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে মূল্য কমানো নিয়ে সম্প্রতি দুই মন্ত্রী দু’ধরনের বক্তব্য দেয়ায় বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, তেলের দাম কমানো হবে না। সরকারকে অনুমতির জন্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে সারা বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে আগামী বছরেও তেলের দাম বাড়তে পারে। সে কারণে এ মুহূর্তে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনো প্রাইজ অ্যাডজাস্টমেন্ট না করার। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। ‘আই অ্যাম নট শিওর অ্যাবাউট ইট।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে যে দামটা আছে, সেটা তো কম। আমাদের দাম তার চেয়ে বেশি।

Recent Posts

Leave a Comment