প্রচারবিমুখ এক ভাষাসৈনিকের কথা

 In খোলা কলাম


তাজওয়ার হোসেন

বিএম কলিমুল্লাহর জন্ম চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে, ১৯২৪ সালে। বাবা ছিলেন তৎকালীন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। স্কুলজীবনেই ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন নিয়ে একটি আন্দোলনে নিজেকে জড়ান বিএম কলিমুল্লাহ। স্কুলে সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা ছিল। একদিন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের পক্ষ থেকে বিএম কলিমুল্লাহ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে বললেন, স্যার, আমাদেরও ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের সুযোগ দিতে হবে।
– বেশ তো করো।
: স্যার, অনুষ্ঠানে একটা গরু জবাই হবে।
বিএম কলিমুল্লাহর কথা শুনে প্রধান শিক্ষক বললেন, আরে, রাম! রাম! তুমি জানো না, এটা হিন্দু জমিদারদের স্কুল!
প্রধান শিক্ষকের নিষেধ উপেক্ষা করে মুসলিম ছাত্ররা ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের আয়োজন করতেই স্কুলে গোলমাল শুরু হল এবং অনাকাক্সিক্ষতভাবে প্রধান শিক্ষক সামান্য আহত হলেন। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বিএম কলিমুল্লাহর সম্পৃক্ত হওয়ার বীজ বপিত হয় মূলত এ ঘটনার মধ্য দিয়েই। এ ঘটনার পর বিএম কলিমুল্লাহ কলকাতায় এসে একটি হাইস্কুলে ভর্তি হন। তবে কলকাতায় বেশিদিন থাকা হয়নি তার। এক আত্মীয়ের উৎসাহে তিনি চলে আসেন খুলনায়। ভর্তি হন খুলনা জিলা স্কুলে। বঙ্গভঙ্গের সময় খুলনার রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তিনি পুনরায় চলে আসেন হাজীগঞ্জে।
এখান থেকে মেট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। বিএম কলিমুল্লাহ জগন্নাথ কলেজে বিকম পরীক্ষার্থী থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে। প্রয়াত আবদুল মতিন (ভাষা মতিন) বিএম কলিমুল্লাহর সিনিয়র হলেও দু’জনের মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের এক সমাবেশে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন এবং আবদুল মতিন যখন লাফ দিয়ে উঠে ‘নো-নো’ বলে চিৎকার করে তার প্রতিবাদ করেন, তখন বিএম কলিমুল্লাহ আবদুল মতিনের পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন। কক্সবাজারের ফরিদ আহমদও ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বিএম কলিমুল্লাহ জানান, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ ফ্যাকাল্টি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের দক্ষিণ পার্শ্বে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে কারফিউ জারির পর সেখানকার একটি আমগাছের নিচে আমরা জমায়েত হওয়ার পর দু’ধরনের মত দেখা দিল। একদল কারফিউ ভঙ্গের পক্ষে। অন্য দল কারফিউ ভঙ্গের বিপক্ষে। মতিন ভাই বললেন, যে কোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। কয়েকজন ছাত্রীকে সামনে রেখে ছাত্রদের প্রতিবাদী মিছিল রাস্তায় নামল। রাত আনুমানিক ৩টায় ছাত্র-পুলিশ মুখোমুখি হল। পরে সেই মিছিলেই গুলি চালায় পুলিশ।
এ প্রেক্ষাপটে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলে আবদুর রব নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মীর সঙ্গে চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে ছাত্রদের সংগঠিত করার দায়িত্ব পেলেন বিএম কলিমুল্লাহ। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা…
ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালির স্বাধীনতা লাভের দ্বার উন্মোচিত হয়। ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে দেশের মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, শামসুল হক, নাইমুদ্দিন আহমেদ, অলি আহাদ, কমরুদ্দিন আহমেদ, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল মতিন, আবুল কাশেম, মো. তোয়াহা, গোলাম মাওলা ও গাজীউল হক। আমরা মনে করি, এ তালিকায় প্রচারবিমুখ ভাষাসৈনিক বিএম কলিমুল্লাহর নামও অনায়াসে যুক্ত করা যেতে পারে।
তাজওয়ার হোসেন : শিক্ষার্থী, ঢাকা

Recent Posts

Leave a Comment