বিধি ভেঙে ৩০০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ

 In প্রধান খবর

সুদ মওকুফ নিয়েও বড় ধরনের অনিয়ম করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। বিধি ভঙ্গ করে প্রায় ৩১০ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়, যা অনুমোদন করে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এর মধ্যে আরোপিত সুদের পরিমাণ ১০৭ কোটি এবং অনারোপিত ২০২ কোটি টাকা। মওকুফের মাধ্যমে এ সুবিধা দেয়া হয়েছে পৃথক ১০ ঋণ গ্রহীতাকে। এর মধ্যে ৬ গ্রাহকই ঋণখেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে অনিয়মের এ বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, কোনো ঋণগ্রহীতার সুদ যখন মওকুফ করার প্রশ্ন আসবে তখন সবার আগে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড (পরিচালন ব্যয়) আদায় করে নিতে হবে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতার সেবা প্রদানকালীন ব্যাংকটির গড় পরিচালন ব্যয় (যা ব্যাংক ভেদে নির্ধারিত থাকে) আগে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক এক্ষেত্রে তা অনুসরণ করেনি। কস্ট অব ফান্ড আদায় ছাড়াই ঋণের সুদ মওকুফ করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু অন্যায় সুবিধা দেয়া হয়েছে তাই ধরে নেয়া যায়, এখানে দুর্নীতি হয়েছে। তৃতীয় কোনো পক্ষ লাভবান না হলে এভাবে ঋণের সুদ মওকুফের সুবিধা দেয়ার কথা নয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংককে। ফলে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, অগ্রণী ব্যাংক আইনের বাইরে কিছু করে থাকলে অবশ্যই দেখা হবে। ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ বোর্ড রয়েছে। বোর্ড যদি নিয়ম না মেনে কাজ করে, সেটি হবে অপরাধ। এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে এলে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখা হবে।

এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস উল ইসলাম বলেন, নীতিমালার আলোকে সুদ মওকুফ করা হয়। এর ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার জানা নেই। প্রতিবেদন আমার কাছে এখনও পৌঁছেনি। কী কারণে এ ধরনের সুদ মওকুফ করা হয়েছে, বলতে পারছি না। তিনি বলেন, অনেক সময় পরিস্থিতির কারণে মওকুফ করতে হয়। কারণ মামলা করে টাকা আদায় করা যায় না।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণগ্রহীতার কেইসের যথার্থতার ভিত্তিতে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ আরোপিত ও অনারোপিত সুদ মওকুফ করে। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক তা অনুসরণ না করলে জবাব চাওয়া হবে। সূত্র জানায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমানের কাছে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের বিদ্যমান নীতিমালা পুরোপুরি মেনে চলার বিধান রয়েছে। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ১০ জন গ্রাহকের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করেনি। ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সড়ক, নদী ভাঙন বা দুর্দশাজনিত কারণে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কস্ট অব ফান্ড আদায়ের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা যাবে।

জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৪৭৩, ৪৭৮, ৪৮১ ও ৪৮২তম সভায় ১০ জন গ্রাহকের সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেখানে ব্যাংকের প্রাপ্য পরিচালন ব্যয় কেটে রাখা বা উসুল করা হয়নি। এটি একটি গুরুতর অনিয়ম। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এসডিএস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেড, মেসার্স আলম ব্রাদার্স, পলি ফেব্রিক্স লিমিটেড, ইনফিনিট টেকনোলজি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মৌরিশাস ইন্টারকন্টিনেন্টাল লিমিটেড, মহারাজা ফার্টিলাইজার অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মেসার্স মোস্তাক ব্রাদার্স, মান্নান বুক অ্যান্ড হাউস এবং ইশা গার্ডেন (প্রা.) লিমিটেড। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার প্রধান শাখা খেলাপি ঋণগ্রহীতা এসডিএস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে মোট ১৯৬ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়। এর মধ্যে অনারোপিত সুদের পরিমাণ ১৫৫ কোটি টাকা এবং সুদ অনিশ্চিত হিসেবে রক্ষিত ৪১ কোটি টাকা। এ ঋণগ্রহীতার কস্ট অব ফান্ড ঘাটতি রাখা হয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণগ্রহীতা চৌধুরী অ্যঅন্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেডকে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করা হয়। এর মধ্যে অনারোপিত সুদ প্রায় পৌনে দুই কোটি এবং ইন্টারেস্ট সাসপেন্ড হিসাবে রক্ষিত প্রায় ৮৬ লাখ টাকা। এই গ্রাহকের কস্ট অব ফান্ড ঘাটতি হচ্ছে ২ কোটি টাকা। খুলনার স্যার ইকবাল রোড কর্পোরেট শাখা খেলাপি ও মামলাকৃত ঋণগ্রহীতা মেসার্স আলম ব্রাদার্সকে ৬ কোটি টাকা অনারোপিত সুদ মওকুফ করে। বৈদেশিক বাণিজ্য কর্পোরেট শাখা ঢাকার শ্রেণীকৃত গ্রাহক পলি ফেব্রিক্স লিমিটেডকে প্রায় ৬৪ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়। এর মধ্যে অনারোপিত সুদের পরিমাণ প্রায় ৩৯ কোটি টাকা। সাড়ে চার কোটি টাকা কস্ট অব ফান্ড ঘাটতি রেখেই তা মওকুফ করা হয়েছে।

এছাড়া খেলাপি ঋণগ্রহীতা ইনফিনিট টেকনোলজি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ঋণ হিসাবে কস্ট অব ফান্ডে ১ কোটি ১৫ লাখ ঘাটতি দিয়ে প্রায় ১৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছে। অপর প্রতিষ্ঠান মৌরিশাস ইন্টারকন্টিনেন্টাল লিমিটেডের কস্ট অব ফান্ড ঘাটতি রেখে সুদ মওকুফ করা হয় প্রায় ১৮ কোটি টাকা। একইভাবে মহারাজা ফার্টিলাইজার অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে প্রায় ১২ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের কস্ট অব ফান্ড ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আরও দেখা গেছে, মেসার্স মোস্তাক ব্রাদার্সের ঋণের সুদ ৭ লাখ টাকা, খেলাপি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান মান্নান বুক অ্যান্ড হাউসের প্রায় ৯৮ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকার প্রধান শাখার ঋণগ্রহীতা ইশা গার্ডেন (প্রা.) লিমিটেডের দেড় কোটি টাকা কস্ট অব ফান্ড ঘাটতি রেখে সুদ মওকুফ করা হয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কোনো গ্রাহকের সুদ মওকুফের জন্য ২০০৬ সালে ২৯ জুন এবং ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দুটি নীতিমালা জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, আরোপিত সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে কস্ট অব ফান্ড আদায় বাধ্যতামূলক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ইনকাম অ্যাকাউন্ট ডেট না করে তা বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া সব দায় পরিশোধ করে ব্যাংকের ঋণ হিসাব অবসায়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি কেইস মেরিট ভিত্তিতে পরিচালনা পর্ষদ বিবেচনা করবে। সেখানে আরও বলা হয়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গ্রাহকের অনারোপিত সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে প্রতিটি কেইসের যথার্থতা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

প্রসঙ্গত, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আরোপিত সুদ বলতে ঋণ গ্রহণের সময় যে সুদ নির্ধারণ করা হয়েছিল তাকে বোঝাবে। এছাড়া খেলাপি হওয়ার পর অতিরিক্ত সুদ বা জরিমানা হিসেবে যে টাকা নির্ধারণ করা হয় তা হল অনারোপিত সুদ।

উল্লেখ করা যেতে পারে, এর আগে জামানত ছাড়াই চট্টগ্রামের ইলিয়াস ব্রাদার্সকে ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। বিপুল অংকের এ অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই জনৈক মাহতাবের তিন প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিটিএল, মেসার্স মাহিম টেক্সটাইল ও মেসার্স পিনাকল টেক্সটাইল কোম্পানিকে ১৫৬ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। এ অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরির্দশনে উঠে আসে। এছাড়া চটগ্রামের আসাদগঞ্জ শাখার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। পণ্য রফতানির অন্তরালে তা করা হয়েছে। এছাড়া ২০০২-২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে অগ্রণী ব্যাংক।

Recent Posts

Leave a Comment