আঘাতের জবাব আঘাত!
স্পোটর্স রিপোর্টারঃ
সকালের বিপর্যয় আর বিকেলের পা হড়কানো। মাঝখানে দ্যুতিময় সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবাল। মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনে সারাক্ষণই কিছু না কিছু ঘটতে থেকেছে। ধারাভাষ্যকাররা বললেন- ‘স্পাইসি পিচ’। যেখানে ব্যাটসম্যানদের জন্য আছে রান, মাথা খাটালে বোলারদের জন্য তো উইকেট আছেই। তাই দেখা গেল, ২৬০ রান হলো, অলআউটও হয়ে গেল বাংলাদেশ। স্পাইসি দিনে ব্যাটিংয়ে নামা অস্ট্রেলিয়ানদেরও ৩ উইকেট তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। পাল্লা কি সমানে সমান? পিচের মতিগতি দিচ্ছে সে ধারণাই।
দিনের প্রথম চার ওভার দেখে থাকলে আপনি হয়ত বলবেন, বাহ বেশ বেশ। এতটা হয়েছে তবে। আবার যদি মাঝের সময়ে কেবল সাকিব-তামিমের ব্যাটিং দেখেন তবে তো কপাল কুঁচকে যাবে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে- ‘হায় হায়! এই অবস্থা!’
আসলে টেস্ট ক্রিকেট এমনই, প্রতিক্ষণেই রঙ বদলায়। ম্যাচের আগে তামিম যেমন বলেছিলেন, প্রতিটা বল, প্রতিটা মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের কথাটাই যদি মনে থাকত তামিমের। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ওই বলে তবে ওভাবে আউট হন? আসলে সব মনে থাকে না বলেই এটা খেলা।
টস জিতলে এই পিচে চোখ বন্ধ করে যেকোনো অধিনায়ক ব্যাটিং নেবেন। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্টের প্রথম দিনে মুশফিকও তাই করেছিলেন। কে জানত ওভাবে তেতে উঠবেন প্যাট কামিন্স! অস্ট্রেলিয়া দলটির সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার তিনি। আগের রাতের বৃষ্টিতে পিচে কিছুটা ভেজা ভাব। সকালে ঈশান কোনে জমেছিলো মেঘও। মঞ্চ প্রস্তুত দেখে মওকা পেয়ে গেলেন। ঝরালেন আগুন। শুরুর ৩০ মিনিটে তাকে দেখে মনে হলো ‘দুর্বোধ্য’।
টেস্টে ইনফর্ম সৌম্য সরকারকে পেসে পরাস্ত করে যাচ্ছিলেন। অস্বস্তি থেকে বেরুতে ব্যাকফুট ড্রাইভ করতে গিয়েছিলেন সৌম্য। টপ এজ হয়ে তা গেল গালিতে। লাফিয়ে ধরে নিলেন পিটার হ্যান্ডসকম্ব। ১০ রানেই পড়ল প্রথম উইকেট। তখনও কোন সমস্যা ছিলো না। পরের ওভারে ফিরে কামিন্স যেন আরও অগ্নিমূর্তি। পাঁচ ও ছয় নম্বর বলে পরপর আউট করে দিলেন ইমরুল কায়েস আর সাব্বির রহমানকে। দুজনেই কোন রান করতে পারেননি। গতিতে হেরে উইকেটের পেছনে ম্যাথু ওয়েডকে ক্যাচ দিয়েছেন। সাব্বির তো ক্যাচ দেওয়ার পরও রিভিউ নিয়ে তা নষ্ট করেছেন।
১০ রানে তিন উইকেট নাই। মাত্র ৪ ওভারেই! কি হবে বাংলাদেশের! খেলার আগে এত হুঙ্কার কি তবে লুকোতে হবে? যারা বেশি হুঙ্কার দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে, দায়িত্বটা নিলেন তারাই। তামিমের সঙ্গে যোগ দিলেন সাকিব। তখন রীতিমতো কাঁপছিল বাংলাদেশ। সাকিব নেমে সেই কাঁপুনি ফেরত দেন অস্ট্রেলিয়ানদের। উইকেটে গিয়ে কুঁকড়ে না গিয়ে চালান পালটা আক্রমণ। টেস্টে অস্ট্রেলিয়ানরা বরাবরই আগ্রাসী। বাউন্ডারি ফাঁকা, বৃত্তের ভেতরেই বেশিরভাগ ফিল্ডার। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সরাতে পালটা আক্রমণই জরুরি ছিলো। সাকিব করলেন তাই। ঝুঁকি ছিলো বটে। তবে ঝুঁকি নিতেই তো তিনি ভালোবাসেন।
লায়নকে পেলেই জায়গা বের করে খেলেছেন ড্রাইভ। হ্যাজলউড, কামিন্সদের পুল করে পাঠিয়েছেন সীমানার বাইরে। তার দাপটে থিতু হতে পারেননি কোন অস্ট্রেলিয়ান বোলার। ওদিকে তামিম ছিলেন আস্থার প্রতীক। উইকেটে সময় কাটিয়েছেন। খারাপ বল পেলে আবার পেটাতে ভুল করেননি। তামিমের আগ্রাসনের দাপট গেছে ন্যাথান লায়নের উপর দিয়েই। অসিদের সেরা স্পিনারকে ইনসাইড আউট শটে এক্সট্রা কাভার দিয়ে উড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। পরে লঙ অন আর মিড উইকেট দিয়েও মেরেছেন আরও দুই ছক্কা।
সকালের অন্ধকার কেটে তখন আলো ঝলমলে দিনের রেখা। উলটো মুখ ভার স্মিথদের। বেলা বাড়তে দুই বন্ধু আরও চড়াও হয়েছেন, তাদের চওড়া ব্যাটে আবার বয়েছেন বাংলাদেশকে। তবে কাজ কিছুটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে ম্যাক্সওয়েলকে ডেকে পাঠান স্মিথ। ততক্ষণে ১৫৫ রানের জুটি হয়ে গেছে। সাকিব-তামিম দুজনেই তুলে নিয়েছেন হাফ সেঞ্চুরি। ম্যাক্সওয়েলের নিরীহ বলটাতে আউটের রিপ্লে দেখলে নিজেই জিভ কাটবেন তামিম। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে এমন ললিপপ ক্যাচ মিস করার কোন কারণ নাই ওয়ার্নারের। ১৪৪ বলে ৭১ রান করে থামলেন তামিম।
সঙ্গী বিচ্ছেদ কি ভর করেছিলো সাকিবকে? সারাদিন যে লায়নের উপর দিয়েই গেছে ঝড়, তারই টিপিক্যাল অফ স্পিন সাকিবের ব্যাট ছুঁয়ে অধিনায়ক স্মিথের হাতে জমা পড়ল। ১৩৩ বলে ৮৪ রানের ইনিংসে ১১টি চার মেরেছেন সাকিব।
চা বিরতিতে যাওয়ার আগে কতো ম্যাচে যে উইকেট খুইয়েছে বাংলাদেশ। তা গুনতে গেলেও হয়ত রেকর্ড হয়ে যাবে। দুর্দশা কাটেনি চা বিরতির পরও। তখন কেবল সেট হয়েছেন মুশফিক। বাঁহাতি স্পিনার অ্যাস্টন অ্যাগারের বলটা সামনের পায়ে খেলতে গিয়েছিলেন, ভেতরে ঢুকতে থাকা বল মুশফিকের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে লাগল পায়ে। অসিদের জোরালো আবেদন সাড়া দেন আম্পায়ার। খটকা থাকায় রিভিউ নিয়েছিলেন টাইগার অধিনায়ক। বিফলেই গেছে তা।
নাসির হোসেন ফিরেছেন দু বছর পর। তার সাথে মেহেদী হাসান মিরাজ ব্যাট হাতে বিরাট কিছু করে ফেলবেন, এমন আশা নেই। তবে দিনের বাকিটা সময় কাটিয়ে দেওয়ার আশা তো তাদের কাছে করাই যেত। লায়ন-অ্যাগারকে সামলাতে পারেননি তারা। বৃষ্টির পর খেলা শুরু হতেই হুড়মুড় করে পড়েছে বাকি সব উইকেট। লায়নের বলে সিলি মিড অফে ক্যাচ দিয়েছেন মিরাজ। চেহারা দেখে মনে হয়েছে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না। কিন্তু রিভিউও যে বাকি নেই আর। সাকিব ম্যাচশেষে বলে গেলেন, ওটা আউট ছিল না। রিভিউ থাকলে…। নাসিরকে অবশ্য আউট দেননি ফিল্ড আম্পায়ার। অ্যাগারের বলটা প্রথমে তার পায়েই লেগেছিলো। বুঝতে পেরে রিভিউ নেন স্টিভেন স্মিথ। বিকেলের সোনালী আলোয় চওড়া হয় তার হাসি। তিনের নামতা গুনে উইকেট নিয়েছেন তিন অস্ট্রেলিয়ান – প্যাট কামিন্স, ন্যাথান লায়ন আর অ্যাস্টন অ্যাগার। রান কম দিয়ে অ্যাগারই এগিয়ে