মানবসেতুতে হাঁটা চেয়ারম্যানের জামিন বেআইনি: হাইকোর্ট
নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্কুলশিক্ষার্থীদের তৈরি ‘মানবসেতু’র ওপর দিয়ে হেঁটে তুমুল সমালোচিত চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা চেয়ারম্যানের জামিনের বিষয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, আমাদের বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, শিশু আদালতের বিচারক বেআইনিভাবে ওই চেয়ারম্যানের জামিন মঞ্জুর করেছেন।
হাইকোর্ট বলেন, ১৭ ধারায় বলা হয়েছে ‘আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু বা আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু কোনো মামলায় জড়িত থাকিলে, যে কোনো আইনের অধীনেই হউক না কেন, উক্ত মামলা বিচারের এখতিয়ার কেবল শিশু আদালতের থাকিবে।’ অর্থাৎ শিশু আদালতের বিচারক আইনের এই ধারাটি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
ওই চেয়ারম্যানের জামিন বাতিলের রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মতামত তুলে ধরেন।
আদালত আরো বলেন, শিশু আইনের ২৯ ধারায় জামিনে মুক্তির বিষয়ে বলা হয়েছে। অতএব আমাদের বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, শিশু আদালতের বিচারক বেআইনিভাবে ওই চেয়ারম্যানের জামিন মঞ্জুর করেছেন। হাইকোর্ট মনে করেন, শিশুর অধিকার সুরক্ষার জন্যই এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিশু আদালতের বিচারক আইনের এই মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
৩০ জানুয়ারি হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূর হোসেন পাটোয়ারী নীলকমল ওছমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দিয়ে গড়া মানবসেতুতে হাঁটেন। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান নূর হোসেন পাটোয়ারীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে শিশু আইনের ৭০ ধারায় হাইমচর থানায় মামলা করা হয়।
মামলাটি তদন্তাধীন থাকাবস্থায় ওই চেয়ারম্যান ২৯ মার্চ চাঁদপুরের শিশু আদালতে গিয়ে জামিন নেন। এই জামিন আদেশ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে বেঞ্চ মামলা করেন বাদী আবদুল কাদের গাজী। ১৯ জুলাই উপজেলা চেয়ারম্যানকে দেয়া জামিন আদেশ বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তাকে নি¤œ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। জামিন বাতিলের এই রায় সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে।
প্রকাশিত রায়ের পর্যবেক্ষণে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, অভিযুক্ত চেয়ারম্যান বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চে গিয়ে আগাম জামিন প্রার্থনা করেন। কিন্তু তিনি জামিন পাননি। পরে শিশু আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান। হাইকোর্ট মনে করেন, শিশু আদালতের বিচারক এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে প্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্ত ওই চেয়ারম্যানের জামিন আবেদনের শুনানি গ্রহণ করে তা মঞ্জুর করেন। জামিন মঞ্জুর করে শিশু আদালতের বিচারক ওই আইনের গুরুতর ভুল প্রয়োগ করেছেন।
বিদ্যমান শিশু আইনে প্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্তের জামিনের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বিধান নেই বলেও মতামত দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, এই আইনে দায়েরকৃত মামলা তদন্তাধীন থাকাবস্থায় প্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্তের জামিন আবেদন শুনানির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে। ফলে তদন্তকালীন সময়ে ছাড়া এ ধরনের অভিযুক্তের জামিন শুনানির এখতিয়ার শিশু আদালতের নেই।
এর আগে শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে দায়েরকৃত পৃথক চারটি মামলার প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের জামিন আবেদনের শুনানি গ্রহণ করেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রংপুরের শিশু আদালত। আসামি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও জামিন আবেদনের শুনানি গ্রহণ করায় শিশু আদালতের বিচারকদের কাছে ব্যাখ্যা চান হাইকোর্ট। ব্যাখ্যায় শিশু আদালতের বিচারকরা বলেছিলেন, শিশু আইনে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক হলে তার সাজার বিধান এই আইনে সন্নিবেশিত করা হয়নি। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সাজা বা বিচার কোন আদালতে হবে- সেই অস্পষ্টতা নিরসনে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।
এর আগে ২০১৬ সালেল ১৪ আগস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ শিশু আইনের অস্পষ্টতা নিরসনের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেন। এরপর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ অস্পষ্টতা নিরসনে শিশু আইনের সংশোধনীর খসড়া হাইকোর্টে পাঠায়। ওই খসড়ায় বলা হয়, শিশু আইনে অপরাধী প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে। আর শাস্তি হবে প্রচলিত আইনে। সংশোধনীতে শিশু আইনের ১৫ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়, তদন্তকালে শিশুর জন্য শিশু আইন এবং প্রাপ্তবয়স্কের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধিসহ অন্যান্য প্রযোজ্য আইনের বিধান অনুসরণ করতে হবে।