রোহিঙ্গাদের কেন অপছন্দ করে মিয়ানমার?
মিয়ানমার সরকারের কড়াকড়ির কারণে রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দেখা গেছে শুধু আগুন আর কালো ধোঁয়া। সেই সঙ্গে পালিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষের ভিড়। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে নিদারুণ মানবিক সংকটের অন্যতম দৃষ্টান্ত। এটি হলো রোহিঙ্গা সংকট।
গত তিন সপ্তাহে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গা ইস্যু বহুদিন ধরেই মিয়ানমারের অন্যতম আলোচিত সংকট। তবে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ‘রোহিঙ্গা’ বলতে নারাজ দেশটির সেনাবাহিনী। ২৫ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি ও তল্লাশিচৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা এই সংকটকে আরও উসকে দেয়।
ওই সন্ত্রাসী হামলার জেরে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হয়, চলে দমন-পীড়ন। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল-হুসেইন এ নিপীড়নকে ‘জাতিগত নির্মূলের এক আদর্শ উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। সেই ঢল এখনো শেষ হয়নি।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের কেন অপছন্দ করে মিয়ানমার? মানবাধিকারকর্মীদের মতে, রোহিঙ্গাদের পছন্দ না করার মূল কারণ হলো জাতীয়তাবাদ উৎসারিত বর্ণবাদ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক তেজশ্রী থাপা বলছেন, যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছেন, তাঁদের কারওরই মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আশা নেই। তিনি বলেন, ‘বাস্তব অবস্থা খুব খুব খারাপ। কোনো ছবি দিয়ে সেটি বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমি অনেক শরণার্থীদের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু কোনো শরণার্থীদের এতটা বিধ্বস্ত অবস্থায় পাইনি।’
রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-নিপীড়ন নতুন কিছু নয়। দশকের পর দশক ধরে এই সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সামরিক জান্তা সরকারের আমলে চলা সহিংসতা থেকে কোনোক্রমে রক্ষা পেয়েছিল তারা। কিন্তু তখন থেকেই হারাতে হয় মৌলিক অধিকার। মানবাধিকারকর্মী ও বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা অনেক বছর ধরেই গণহত্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সহজ লক্ষ্য তারা। রোহিঙ্গারা একটি ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এবং এদের চেহারা ও ধর্ম—দুই-ই ভিন্ন। সুতরাং রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করাও সহজ।’মিয়ানমার একসময় বার্মা নামে পরিচিত ছিল। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে পরিণত হয় এটি। ওই সময় কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের প্রবেশাধিকার ছিল। ১৯৭৪ সালে রাখাইন এলাকা রাজ্যের মর্যাদা পায়। এর কয়েক বছর পরই, ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে, রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটে। তখনই প্রথমবারের মতো প্রচুরসংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে। অবশ্য মিয়ানমারের তৎকালীন জান্তা সরকারের ভাষ্য ছিল, ‘অবৈধ অভিবাসনের’ বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে।
এর এক বছর পর অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা সরকার ওই সব লোককে নাগরিক ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগত অধিকার কেড়ে নেয়। ১৯৯৪ সালে নতুন জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের সরকারি জন্মসনদের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করা শুরু হয়। অং সান সু চির নেতৃত্বে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন হলেও রোহিঙ্গাদের বঞ্চনা কিন্তু শেষ হয়নি। রোহিঙ্গাদের বাদ রেখেই চালানো হয় ২০১৪ সালের আদমশুমারি।
গত ৫০ বছরে মোট তিন দফায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ১৯৭৭-৭৮, ১৯৯১-৯২ ও ২০১২ সাল। প্রতিবারই সহিংসতা এড়াতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এসব সহিংসতা ও নিপীড়নের অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করছে মিয়ানমারের সরকার। গত এপ্রিলে অং সান সু চি জাতিগত নির্মূলের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস রেসপন্স বিভাগের পরিচালক তিরানা হাসান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নের জন্য মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে সুনির্দিষ্টভাবে প্রচারাভিযান চালিয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে জাতিগত নির্মূল বলাটা কোনো ভুল নয়। সেখানে ছকে বাঁধা নিয়মে ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালানো হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী একেকটি গ্রাম প্রথমে ঘিরে ফেলছে, পরে গুলি করছে এবং আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। আইনি ভাষায় বললে, এটি হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ।’
এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষণা কর্মকর্তা তেজশ্রী থাপা। আগে চালানো হামলার সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘এটি একটি সুসমন্বিত কর্মসূচি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সবাইকে তাড়িয়ে দেওয়াই এর মূল লক্ষ্য।’
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরোধ ও দ্বন্দ্ব কিন্তু আজকের নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে এই সম্পর্কে উত্তেজনার শুরু। ব্রিটিশরা স্বাভাবিকভাবেই বিভক্তি ও শাসননীতি প্রয়োগ করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসকেরা অন্যান্য গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের চেয়ে মুসলিমদের পছন্দ করত বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলিমদের সেনা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল ব্রিটিশরা। অন্যদিকে বৌদ্ধ ও অন্যান্য সম্প্রদায় জাপানের পক্ষ নিয়েছিল। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, জাপানের সঙ্গে মিলে মিয়ানমার থেকে ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাড়ানো। আর এই জায়গাতেই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়।
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট হলো ‘বাঙালি ইস্যু’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের সরকারি পেজে গতকাল শনিবার দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘তারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করছে, অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না।’ আর এই সত্য প্রতিষ্ঠায় একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে দেশটির স্টেট কাউন্সেলরের পদে থাকা নোবেলজয়ী অং সান সু চি জাতিগত সহিংসতার যেকোনো অভিযোগই এককথায় নাকচ করে দিচ্ছেন। জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ সভাতেও সম্ভবত যোগ দিচ্ছেন না তিনি। মানবাধিকারকর্মীরা অবশ্য আশা করছেন, সু চি অনুপস্থিত থাকলেও জাতিসংঘের সাধারণ সভায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হবে।
রোহিঙ্গারা অবশ্য এখনো নিজেদের জন্মভূমিতে জীবন কাটানোর আশাতে আছেন। সেই সঙ্গে তাঁরা চান সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি। মানবাধিকারকর্মী ও বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেন, ‘আমরা আমাদের জন্মভূমিতে শান্তিতে দিন কাটাতে চাই। অন্য দেশে থাকতে চাই না আমরা। সু চি তাঁর নিজের স্বাধীনতাটুকু যেন আমাদের পৃষ্ঠপোষণায় ব্যবহার করেন—এটুকুই আমার আহ্বান।’
নিউজউইক ও এএফপি অবলম্বনে অর্ণব সান্যাল