রোহিঙ্গাদের পাশে চাই গোটা বিশ্বকে : হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
এটা ছিল আমার এক নির্মম অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা আমি কখনো দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ভাবিনি।
এই সভ্য জগতে মানুষ দ্বারা মানুষ এত নির্যাতিত হতে পারে— তা কি কল্পনাও করা যায়! গিয়েছিলাম কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য। যা দেখে চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি— একি দেখলাম আমি। যা শুনে কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি— কী শুনলাম আমি! মানুষের এত দুর্দশা কি চোখে দেখা যায়? যে সব নির্যাতনের কথা শুনলাম— তা কি শ্রবণাধার ধারণ করতে পারে?
প্রতিবেশী মিয়ানমারের একটি প্রদেশ রাখাইন। মুঘল যুগ থেকে এখানে অন্যান্য ধর্ম-বর্ণ ও জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরও বাস। এ অঞ্চলটি আরাকান নামেও পরিচিত। আরাকান রাজসভাকে সমৃদ্ধ করে রেখেছিলেন মুসলিম কবি আলাওল। সেই কবির স্মৃতিবিধৌত— এই রাখাইন রাজ্য। শত শত বছর ধরে নিজ বাসভূমি হিসেবে রোহিঙ্গারা এখানে বাস করে আসছে। বার্মা থেকে নাম বদলে মিয়ানমার। রোহিঙ্গারা এই মিয়ানমারেরই নাগরিক। হয়তো তারা মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কিংবা মঙ্গোলিয়ান জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। অথবা তাদের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে বর্মী ভাষার মিল বা সাদৃশ্য নেই। এই ধর্ম-ভাষা বা চেহারার অমিলটাই কি রোহিঙ্গাদের জন্য কাল হয়ে গেল?
যুগ যুগ ধরে বর্মী শাসকরা রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, শাসন-শোষণ চালিয়ে আসছে। সেই নির্যাতন থেকে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও দ্রোহের আগুন জ্বলছে। এটাই স্বাভাবিক। অত্যাচারে পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়— তখন সামনে এগোনো ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। কারও স্বাধিকার আদায়ের প্রচেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। সেই পর্যায়ে শান্তিপূর্ণ পথে সংকট নিরসনের পথ খোঁজা হয়। রাখাইন সমস্যা প্রশ্নে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূতপূর্ব মহাসচিব কফি আনানের রিপোর্টটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সেটা বাস্তবায়ন করা হলে— রোহিঙ্গা সমস্যা আজ এত ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছত না। আমি মনে করি এখনো সুযোগ আছে— কফি আনানের রিপোর্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাখাইনের সমস্যা সমাধান সম্ভব।
আজ রাখাইনে যা ঘটছে— তা সভ্য দুনিয়ায় অকল্পনীয় ঘটনা। কোনো দেশ বা জাতি কিংবা কোনো সরকার এতটা নির্দয়-বর্বর এবং পাশবিক হতে পারে— তা চিন্তারও বাইরে। উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যে অবস্থা দেখেছি বা শুনেছি— তা বর্ণনা করতে কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে যায়— লিখতে গেলে কলম থেমে যায়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এমন কোনো পরিবার নেই, যে পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য চরম নির্যাতন কিংবা হত্যার শিকার হয়নি। কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্যকেই হত্যা করা হয়েছে। নারীরা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর নির্যাতন করে মেরেও ফেলা হয়েছে। মানুষ মেরে কেটে কুচিকুচি করা হয়েছে। নদীতে-সাগরে রোহিঙ্গাদের লাশ ভেসেছে কলার ভেলার মতো। কি অপরাধ করেছিল রোহিঙ্গা শিশুরা। কিছু না বোঝার আগে— তাদের বুকে বুলেট বিদ্ধ হয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুরা লাশ হয়ে নদীতে ভেসেছে। এই দৃশ্য কি কোনো মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব? আর এ কাজটি যারা করেছে- তাদের কোন হিংস্র পশুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়?
একটি আদর্শ দেশ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী বা জাতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। সেখানে শুধু এক জাতি-এক ধর্ম-এক ভাষা থাকতে হবে— আর অন্যরা থাকতে পারবে না— এটা মানব সমাজের নীতি-আদর্শ বা চরিত্র নয়। এটা শুধু বন্যপশুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন হাতির পালে শুধু হাতি থাকে— হায়নার সঙ্গে হায়না— বাঘের দলে শুধু বাঘ। বর্মিরাও কি মানব বিশ্বে সেই পরিচয় দিতে চায়? অনাদিকাল ধরে মানুষ পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে চলে সুবিধামতো স্থলে আবাস গড়ে তোলে। আমাদের ভূ-ভাগে ইরান-তুরান-আরব-ইউরোপ-আফ্রিকা থেকে মানুষ এসেছে। মুঘল-পাঠান-তুর্কি কত না জাতি এসেছে। এই অনার্যের দেশে আর্যদের আগমন ঘটেছে। সবার সমন্বয়ে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। উন্নত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আধুনিক ও সুসভ্য সব দেশের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। আমেরিকায় যদি ব্রিটিশরা না যেত তাহলে ওই অঞ্চলটায় শুধু রেড-ইন্ডিয়ানরাই বাস করত— যারা এখনো উদোম শরীরে থাকে। মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ যে ধর্ম ও বর্ণের জাতি গোষ্ঠী বাস করে— তারা শুধু ওই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তাদের আবাসস্থল রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের অনেক আদি বাসিন্দা— অনেক আগে জীবন ও জীবিকার স্বার্থে আমাদের দেশেও চলে এসেছে। পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় তারা বাস করছে। এখনো তারা রাখাইন নামে পরিচিত। এখানে তাদের বাড়ি-ঘর-জমি-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্যাগোডা রয়েছে। তারা শান্তিতে নির্বিঘ্নে বসবাস করছে। আমাদের দেশ ছোট একটি দেশ। অথচ এখানে বহু ধর্ম-বর্ণ-জাতি গোষ্ঠী এবং বহু ভাষাভাষী মানুষ একত্রে সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছে। এখানে চাকমা-মারমা-চিপরা-সাঁওতাল-মণিপুরিসহ কত না জাতি রয়েছে। মিয়ানমারের উচিত বাংলাদেশকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করা।
বাংলাদেশের চেয়ে বৃহৎ আয়তন এবং অনেক কম জনসংখ্যার দেশ মিয়ানমার। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র ১৩ লাখ। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু হিন্দু আছে- আবার কিছু বৌদ্ধও আছে। দেখা যাচ্ছে- মুসলিম রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু হিন্দুও রাখাইন থেকে বিতাড়িত হয়েছে কিন্তু সেখান থেকে কোনো বৌদ্ধ বিতাড়িত হয়নি। ফলে এটাও প্রমাণ হয় যে, ধর্মীয় কারণেই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশ ছাড়া করা হয়েছে। ১৩ লাখ মুসলমানের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাকি তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে হয়তো বর্মি সামরিক জান্তার হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের এমন সামর্থ্য নেই যে, ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে পারবে বা তাদের খাবার দিতে পারে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের রয়েছে চরম বেকার সমস্যা। সেই সঙ্গে এখন দেশে আছে খাদ্য ঘাটতি। তার ওপর ফসলি মৌসুমে উপর্যুপরি বন্যায় ধানি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে আগামী সময়টা আরও ভয়াবহ রূপে দেখা দেবে হয়তো। তার ওপর এই শরণার্থীর চাপ। জাতি হিসেবে আমরা মানবিক দিক থেকে অত্যধিক সংবেদনশীল। তাই জংলি বর্মিদের অত্যাচারে বিপর্যস্ত একটি জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের এমন দুর্দিনে আমরা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের সরকার রোহিঙ্গাদের সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে। আমাদের জনগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বিপন্ন অসহায় রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থীদের কাছে চলে গেছি। আমি দেশের বিত্তবান প্রতিটি মানুষের প্রতি আহ্বান জানাই— রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর সাহায্যে এগিয়ে আসুন। আমি দেখে এলাম— আশ্রিতরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাদ্য সাহায্য তারা পাচ্ছে— কিন্তু শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুখাদ্য- বিশেষ করে দুধ তারা পাচ্ছে না। ক্ষুধার্ত শিশুরা দুধের জন্য কাঁদছে— কিন্তু অসহায় মায়েদের কিছুই করার নেই। তাই ত্রাণ সাহায্যের মধ্যে অবশ্যই শিশুখাদ্য রাখতে হবে।
বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আকুল আবেদন থাকবে— রোহিঙ্গা আশ্রিতদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। মানবতাকে জাগ্রত করুন। রোহিঙ্গাদের বাসভূমি তাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করুন। বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা বিশ্বের উন্নত দেশসমূহকে বিবেচনা করতে হবে। আমার বিশ্বাস জাতিসংঘ হাত গুটিয়ে থাকবে না। তবে এই মুহূর্তে প্রয়োজন— খাদ্য সাহায্য-শিশুখাদ্য-চিকিৎসা সেবা এবং উপযুক্ত আশ্রয় শিবির।
রোহিঙ্গাদের সমস্যা এভাবে আর যুগের পর যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এবার তাদের ওপর দিয়ে যা ঘটে গেছে এবং এখনো ঘটছে তা বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার সব রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছে। সুতরাং মিয়ানমারের এহেন আচরণ আর সহ্য করা যায় না। তারা মনুষ্যত্ব-মানবিকতা পদদলিত করেছে। রোহিঙ্গারা মুসলমান বিধায় তাদের ওপর যখন এ ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে— তাই তার প্রতিকার হিসেবে মুসলিম বিশ্বকেও সোচ্চার হতে হবে। সেই সঙ্গে বিশ্ব সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে অবিলম্বে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকার কোনো ধরনের টালবাহানা করলে— গোটা বিশ্ব থেকে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপসহ কূটনৈতিক সম্পর্কোচ্ছেদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কফি আনানের রিপোর্ট বাস্তবায়নের পাশাপাশি রাখাইনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়োগ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে পুনর্বাসন এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের কোনো বিকল্প নেই। জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে প্রয়োজন মতো সৈন্য নিতে পারবে। আমাদের গর্বিত বাহিনী শান্তি মিশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। রাখাইন রাজ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
মিয়ানমারের বিগত অভিজ্ঞতা বলে— তাদের ক্ষেত্রে সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ বা শক্তি প্রয়োগ ছাড়া বিকল্প পথ নেই। যদি তাদের শুভবুদ্ধি উদয় হয়— তাহলে সেটা হবে মিয়ানমারের জন্যই মঙ্গলকর। পরিশেষে রোহিঙ্গা জনগণের উদ্দেশে বলতে চাই— তোমরা আজ আর একা নও। আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে— গোটা বিশ্ব থাকবে তোমাদের পাশে। সাহস হারিও না। আমাদেরও এক কোটি মানুষকে একবার শরণার্থী হতে হয়েছিল। তারা ফিরে এসেছে- স্বাধীন দেশে। তোমরাও স্বদেশে ফিরে যাবে- স্বাধিকার আদায় করে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রপতি।